ঢাকা, সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১

বিভিন্ন অনিয়মে বাতিল হওয়া ক্রাফটসম্যান প্লেসমেন্ট ইস্যু করে পেয়ে গেল কিউআইও

২০২৪ এপ্রিল ০৩ ১১:২৮:০৯
বিভিন্ন অনিয়মে বাতিল হওয়া ক্রাফটসম্যান প্লেসমেন্ট ইস্যু করে পেয়ে গেল কিউআইও

অর্থ বাণিজ্য প্রতিবেদক : প্রথমবার ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকের (জুলাই-সেপ্টেম্বর ২০২২) নিরীক্ষিত আর্থিক হিসাব দিয়ে ৭ কোটি টাকা উত্তোলন করতে আবেদন করেছিল ক্রাফটসম্যান ফুটওয়্যার অ্যান্ড এক্সেসরিজ। সে দফায় কোম্পানিটির নানা অনিয়মের কারনে কোয়ালিফাইড ইনভেস্টর অফারের (কিউআইও) আবেদন বাতিল করে দিয়েছিল বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। এরপরে ৪ কোটি ৯০ লাখ টাকার প্লেসমেন্ট শেয়ার ইস্যুর মাধ্যমে পরিশোধিত মূলধন বাড়িয়ে পূণ:রায় কিউআইও আবেদন করে ক্রাফটসম্যান কর্তৃপক্ষ। এ দফায় কোম্পানিটিকে আটকায়নি বিএসইসি।

এ কোম্পানি কর্তৃপক্ষ ২য় দফায় কিউআইও’তে ২০২২-২৩ অর্থবছরের পূর্ণাঙ্গ আর্থিক হিসাব দাখিলে ৭ কোটি থেকে কমিয়ে ৫ কোটি টাকা উত্তোলনের আবেদন করে। তবে ওই ২য়বার আবেদনের আগে ৪ কোটি ৯০ লাখ টাকা উত্তোলন করলেও তা দিয়ে ব্যবসা সম্প্রসারণ, ঋণ পরিশোধ ও চলতি মূলধনের কাজে লাগানো হয়নি। অথচ এসব কাজকে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনায় শেয়ারবাজারে আসার চেষ্টা করছে শুরু থেকেই। যা করবে বলে ১ম দফায়ও আবেদন করেছিল।

ক্রাফটসম্যানে কর্মকর্তা-শ্রমিকদের বেতনাদি নিয়ে অসামঞ্জস্য দেখা দিয়েছে। এ কোম্পানিটির আর্থিক হিসাবে বেতন ও মজুরিবাবদ মাথাপিছু মাসিক গড় ৯৭৩৬ টাকা ব্যয় দেখানো হয়েছে। উর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ গড়ে এই বেতনাদি দেখানো হয়েছে। যেটাকে বাস্তবতার সঙ্গে কোন মিল নেই বলে মনে করছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা। শেয়ারবাজার থেকে অর্থ সংগ্রহ করতে গিয়ে বেতনাদি নিয়ে কারসাজির আশ্রয় নেওয়া হয়ে থাকতে পারেন বলে মনে করছেন তারা।

আরও পড়ুন......

অতিরঞ্জিত সম্পদ ও ইপিএস দেখিয়ে টাকা তুলতে যাচ্ছে ক্রাফটসম্যান ফুটওয়্যার

কোম্পানিটিতে মোট ৮২৯ জন কর্মকর্তা-কর্মচারি রয়েছে। যারা সবাই মিলে ২০২২-২৩ অর্থবছরে বেতনাদি পেয়েছেন ৯,৬৮,৫৯,২৬৪ টাকা। যা গড়ে প্রত্যেকে পেয়েছে ৯৭৩৬ টাকা। এখন উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের যদি বাদ দেওয়া হয়, তাহলে নিচের সারির কর্মচারীদের গড় বেতন কমে আসবে। যেমন কোম্পানিটিতে (৪-৭) শীর্ষ ৪ কর্মকর্তা পেয়েছেন ৩৭ লাখ ৯৬ হাজার টাকা। এই টাকা যদি মোট বেতনাদি থেকে বাদ দিয়ে (৮২৯-৪) ৮২৫ জনের মধ্যে গড় হিসাব করা হয়, তাহলে কমে আসবে ৯৩৫৫ টাকা। এভাবে উপরের বা বেশি বেতন পাওয়া কর্মকর্তাদের বাদ দিলে নিচের সারির কর্মচারিদের বেতন গড়ে অনেক কম হবে। যা বর্তমান বাজার প্রেক্ষাপটে সম্ভব না।

অথচ বিএসইসিতে ইস্যু ম্যানেজারদের সঙ্গে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে ক্যাপিটাল রেইজিং বিভাগের একসময় দায়িত্বে থাকা বিএসইসির নির্বাহি পরিচালক মোহাম্মদ রেজাউল করিম বলেছেন, প্রসপেক্টাসে যদি মোট বেতনাদিকে কর্মকর্তা-কর্মচারি দিয়ে ভাগ করে মাসিক গড় ১০-১২ হাজারের নিচে চলে আসে, তাহলে বুঝতে হবে সমস্যা আছে। নিশ্চয় সেখানে কারসাজির আশ্রয় নেওয়া হয়। এসব কোম্পানিকে কমিশন আইপিও দেবে না।

এ বিষয়ে শীর্ষ এক মার্চেন্ট ব্যাংকের প্রধান নির্বাহি কর্মকর্তা (সিইও) অর্থ বাণিজ্যকে বলেন, উর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ একটি কোম্পানিতে কর্মকর্তা-কর্মচারিদের গড় বেতন ১২ হাজার টাকার নিচে হওয়ার সুযোগ নেই। নিচের পদে কর্মচারি যদি ৭ হাজার টাকা করেও পায়, তাহলে উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বেশি বেতনের কারনে গড়ে তা ১২ হাজার টাকার উপরে হবে। তাই কোন কোম্পানির প্রসপেক্টাসে যদি গড় বেতন ১০ হাজারের নিচে নেমে আসে, তাহলে অবশ্যই বুঝতে হবে সমস্যা আছে। হয়তো কর্মকর্তা-কর্মচারি বেশি দেখানো হয়েছে, অথবা ব্যয় কমিয়ে মুনাফা বেশি দেখানো হয়েছে।

ক্রাফটসম্যান কর্তৃপক্ষ ভবন নির্মাণে ব্যয় বেশি দেখিয়ে সম্পদ বেশি দেখিয়েছে। কোম্পানিটির ৮৮০৯২ স্কয়ার ফিটের (রাস্তা ছাড়া) ৩ তলা কারখানা রয়েছে। যা নির্মাণে ২২ কোটি ৭৭ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে বলে তথ্য প্রকাশ করেছে ক্রাফটসম্যান কর্তৃপক্ষ। এক্ষেত্রে প্রতি স্কয়ার ফিটে ব্যয় দেখিয়েছে ২৫৮৫ টাকা (জমি ছাড়া)। অথচ ১০ তলা ভবন নির্মাণে ভিত্তি অনেক মজবুত করার ক্ষেত্রেও প্রতি স্কয়ার ফিটে এতো ব্যয় হয় না। কোম্পানিগুলো শেয়ারবাজারে আসার আগে অস্বাভাবিক নির্মাণ ব্যয় দেখিয়ে সম্পদের পরিমাণ অতিরঞ্জিত করে প্রকাশ করে। এর মাধ্যমে পরিশোধিত মূলধন বাড়ায় এবং নিজেদের শেয়ার সংখ্যা বাড়িয়ে নেয়।

এ বিষয়ে প্রকৌশলী ও একটি ডেভেলপার কোম্পানির কর্ণধার মো: হাবিবুর রহমান অর্থ বাণিজ্যকে বলেন, জুতা কোম্পানির ভবন নির্মাণে ২৫৮৫ টাকা ব্যয় হওয়ার সুযোগ নেই। যত ভালো মানেরই করা হোক না কেনো, সেটা বর্তমান জিনিসপত্রের বাজার দরেও ওই টাকা লাগবে না। তবে আসল কথা হলো প্রায় সব কোম্পানিই শেয়ারবাজারে আসার আগে প্রতারণার জন্য বেশি করে দেখিয়ে থাকে।

এই কোম্পানি কর্তৃপক্ষ অন্যসব কোম্পানির বাহিরে গিয়ে শেয়ারপ্রতি নিট সম্পদ গণনা করেছে ওয়েটেড শেয়ার দিয়ে। যে ওয়েটেড শেয়ার গণনাও ভুল। তবে শেয়ারবাজারে আসা সব কোম্পানিই সম্পদ মূল্য একটি নির্দিষ্ট তারিখের দেখানোর কারনে মোট শেয়ার দিয়ে নিট সম্পদকে ভাগ করে দেখিয়ে এসেছে। কিন্তু ক্রাফটসম্যান ২ কোটি ৩০ লাখ শেয়ারের পরিবর্তে ওয়েটেড শেয়ার দিয়ে গণনা করে ১৩.২০ টাকার এনএভিপিএসকে ১৬.৭২ টাকা দেখিয়েছে।

ক্রাফটসম্যান কর্তৃপক্ষ প্রসপেক্টাসের ১২২ পৃষ্টায় শেয়ারপ্রতি নিট সম্পদ মূল্য (এনএভিপিএস) হিসেবে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ০০, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৩.৮১ টাকা এবং ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৪.৪০ টাকা দেখিয়েছে। তারা ২০১৮-১৯ এবং ২০১৯-২০ অর্থবছরে অভিহিত মূল্য ১ টাকা বিবেচনায় এনএভিপিএস গণনা করেছে। কিন্তু ওই সময় অভিহিত মূল্য ছিল ১০০ টাকা। ১০০ টাকা বিবেচনায় এনএভিপিএস হয় ৩৮১ ও ৪৪০ টাকা। ১৪৩ পৃষ্টাতেও ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৩.৮১ টাকা এবং ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৪.৪০ টাকা দেখানো হয়েছে।

এসব বিষয়ে জানতে গত ১৩ মার্চ ক্রাফটসম্যান কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিতভাবে জানতে চাই। যার আলোকে ৩১ মার্চ তারা মাত্র ৪টি বিষয়ে জবাব দিয়েছে। এরমধ্যে বেতনাদি নিয়ে বলেছেন, সরকারি প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, ষষ্ঠ গ্রেডের একজন কর্মচারীর জন্য মূল বেতন নির্ধারণ করা হয়েছে ৩,৫০০ টাকা, বাড়ি ভাড়া ১,৭৫০ টাকা, চিকিৎসা ভাতা ৬০০ টাকা (সকল গ্রেডের কর্মচারীদের জন্য), ৩৫০ টাকা পরিবহন ভাতা ও ৯০০ টাকা খাবারের ভাতা এবং সব মিলিয়ে মোট বেতন দাঁড়ায় ৭,১০০ টাকা। আমরা যদি ক্রাফটসম্যানের কর্মচারীদের ন্যূনতম গড় বেতনের দিকে তাকাই, তাহলে দেখা যায় তার পরিমাণ ৯,৩৫৫ টাকা, যা এই সংক্রান্ত অভিযোগকে অকার্যকর প্রমাণ করে। ক্রাফটসম্যান যে শিল্পের অংশ সেই জুতা ও চামড়াজাত পণ্যের শিল্পের জন্য নির্ধারিত সর্বনিন্ম বেতন ৭,১০০ টাকা।

পাঠকের মতামত:

শেয়ারবাজার এর সর্বশেষ খবর

শেয়ারবাজার - এর সব খবর



রে