ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

এখনো এফডিআর সুদে ভর করে চলে স্টক এক্সচেঞ্জ

২০২৪ মে ২৭ ১০:০০:৫৫
এখনো এফডিআর সুদে ভর করে চলে স্টক এক্সচেঞ্জ

ইব্রাহিম হোসাইন (রেজোয়ান) : দেশের শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) এবং চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ (সিএসই) প্রতিষ্ঠার পরে দীর্ঘ সময় পার করলেও এখনো এফডিআর এর সুদের উপর ভর করে চলছে। উভয় স্টক এক্সচেঞ্জে উচ্চ বেতনে কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হলেও ব্যবসায় কোন উন্নতি হচ্ছে না। তাই এফডিআর এর সুদ থেকে লভ্যাংশ নিয়েই তৃপ্ত থাকতে হচ্ছে শেয়ারহোল্ডারদের। এমনকি এফডিআর না থাকলে, অস্তিত্ব সংকটের শঙ্কায় পড়তে হতো স্টক এক্সচেঞ্জ দুটিকে।

শেয়ারবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ অর্থ বাণিজ্যকে বলেন, এরা এফডিআরেই চলবে। যেখানে তদবির করে নিয়োগ পাওয়া যায়, সেখানে ভালো কিছু আশা করা যায় না। অথচ স্টক এক্সচেঞ্জে দক্ষ জনবল নিয়োগ দেওয়া উচিত। যারা স্টক এক্সচেঞ্জের ব্যবসায় উন্নতি করতে সক্ষম। আর সিএসইতে তো লেনদেনই হয় না। এরা বসে বসে বেতন ভাতা নিতেছে। একইসঙ্গে পর্ষদের লোকজনও ভালো মিটিং ফি নিচ্ছে।

ডিএসইর ৫৬ বছর ও সিএসইর ২৭ বছরের দীর্ঘ পথচলায় উভয় স্টক এক্সচেঞ্জে পরিচালনা পর্ষদ ও ম্যানেজমেন্টের অনেক পরিবর্তন হয়েছে। উচ্চ বেতনে ম্যানেজমেন্টের লোকজন নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু স্টক এক্সচেঞ্জের শেয়ারহোল্ডারদের ভাগ্যে পরিবর্তন হয়নি। এখনো এফডিআর থাকার কারনে স্টক এক্সচেঞ্জ দুটি মুনাফায় রয়েছে। আর ‘বি’ ক্যাটাগরির লভ্যাংশ দিতে পারছে।

২০১২-১৩ অর্থবছর পর্যন্ত দেশের উভয় স্টক এক্সচেঞ্জ অলাভজনক প্রতিষ্ঠান ছিল। তবে ২০১৩ সালের ২১ ডিমিউচ্যুয়ালাইজড হওয়ার মাধ্যমে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে রুপান্তরিত হয়। এরপর ২০১৪-১৫ অর্থবছর থেকে উভয় স্টক এক্সচেঞ্জকে লভ্যাংশ বিতরন করতে হচ্ছে। তবে এর আগে লভ্যাংশ বিতরন না করায়, তা স্টক এক্সচেঞ্জেই জমা হত। তবে এখন ‘বি’ ক্যাটাগরির লভ্যাংশ দেওয়ার পরেও আর অবশিষ্ট ফান্ড থাকে না। শুরুতে ডিএসইকে ৩ বছর ১০ শতাংশ করে লভ্যাংশ দিতে গিয়ে রিজার্ভ ব্যবহার করতে হয়েছে। তারপরেও ব্যবসায় কোন উন্নতি না হওয়ায় সর্বশেষ অর্থবছরে লভ্যাংশ ৪ শতাংশে নামিয়ে এনেছে। আর সিএসই ৫ শতাংশে সীমাবদ্ধ রয়েছে।

স্টক এক্সচেঞ্জের আয়ের প্রধান উৎস লেনদেন হলেও সুদজনিত আয়ই বেশি হয়। এই অবস্থায় নিজেদের স্বার্থেই স্টক এক্সচেঞ্জের লেনদেন বাড়ানো উচিত। কিন্তু কম হওয়ায় বিভিন্ন মহল থেকে বিএসইসিকে দোষারোপ করা হয়। অথচ নিজেদের স্বার্থেই এটা বাড়ানোর দায়িত্ব স্টক এক্সচেঞ্জের। লেনদেন বেশি হলে স্টক এক্সচেঞ্জ কমিশন পাবে। এর সাথে বিএসইসির কোন ব্যবসা নেই। তারপরেও লেনদেন বাড়ানোর জন্য বিএসইসিকে যতটা ভূমিকা রাখতে দেখা যায়, তা স্টক এক্সচেঞ্জের ক্ষেত্রে চোখে পড়ে না।

স্টক এক্সচেঞ্জের ব্যবসায় উন্নতি না হলেও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পেছনে কম ব্যয় হয় না। উচ্চ বেতনে উভয় স্টক এক্সচেঞ্জে কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হলেও ব্যবসা হয় গতানুগতিক।

বিএসইসি শেয়ারবাজারের প্রধান নিয়ন্ত্রক সংস্থা হলেও স্টক এক্সচেঞ্জের কর্মকর্তাদের বেতন অনেক বেশি। বিএসইসির সর্বোচ্চ কর্মকর্তা মাসে পৌনে ২ লাখ টাকা বেতন পেলেও ডিএসইর এমডির পেছনে ব্যয় হয় ১২ লাখ টাকা। আর সিএসইর এমডির পেছনে ব্যয় ৬ লাখ টাকা। এমনকি ডিএসইর মাসিক গড়ে সব কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পেছনে ব্যয় হয় ১ লাখ ১৪ হাজার টাকা করে।

সিএসইর কর্মকর্তা-কর্মচারীর পেছনে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ব্যয় হয়েছে ১১ কোটি ৮০ লাখ টাকা। আর ১৩ পরিচালকের পেছনে বোর্ড মিটিং ও কমিটি মিটিং ফি বা সম্মানিবাবাদ ১৭ লাখ ১৫ হাজার টাকা ব্যয় হয়েছে। অর্থাৎ গড়ে প্রতি পরিচালক পেয়েছেন ১ লাখ ৩২ হাজার টাকা বা মাসিক হিসাবে ১১ হাজার টাকা।

অপরদিকে ডিএসইর ৩৫৬ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীরর পেছনে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ব্যয় হয়েছে ৪৮ কোটি ৭৪ লাখ টাকা। যা গড়ে প্রতিটি কর্মকর্তা-কর্মচারীর জন্য মাসে ১ লাখ ১৪ হাজার টাকা করে ব্যয় হয়েছে। আর ১৩ পরিচালকের পেছনে বোর্ড মিটিং ও কমিটি মিটিং ফি বা সম্মানিবাবাদ ৫৩ লাখ ৩২ হাজার টাকা ব্যয় হয়েছে। অর্থাৎ গড়ে প্রতি পরিচালক পেয়েছেন ৪ লাখ ১০ হাজার টাকা বা মাসিক হিসাবে ৩৪ হাজার টাকা।

এমন উচ্চ বেতন এবং শ্রমিক না থাকা সত্ত্বেও স্টক এক্সচেঞ্জ দুটিতে গার্মেন্টসের শ্রমিকদের ন্যায় ওয়ার্কার্স প্রফিট পার্টিসিপেশন ফান্ড (ডব্লিউপিপিএফ) গঠন করা হয়। এজন্য উভয় স্টক এক্সচেঞ্জের প্রতিবছর কোটি কোটি টাকার ফান্ড গঠন করতে হয়। এই ফান্ড থেকে স্টক এক্সচেঞ্জের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যে অর্থ পান, তা পুরো বছর কাজ করেও পান না গার্মেন্টসসহ অন্যান্য খাতের শ্রমিকরা। তবে শ্রমিক কাজ না করায় বাংলাদেশ ব্যাংক এক নির্দেশনার মাধ্যমে ব্যাংক ও লিজিং কোম্পানিতে শ্রমিক ফান্ড গঠন থেকে অব্যাহতি দিয়েছে।

ডিএসইতে মুনাফার ৫ শতাংশ হারে গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৫ কোটি ৩৫ লাখ টাকার ফান্ড গঠন করা হয়। যা ডিএসইর ১২ লাখ টাকা সম্মানির এমডিসহ ৩৫৬ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর সবাই পাবেন। অর্থাৎ গড়ে এই ফান্ড থেকে সবাই ১ লাখ ৫০ হাজার করে টাকা পাবেন। আর সিএসইতে ২ কোটি ৪১ লাখ টাকার এই ফান্ড গঠন করা হয়েছে।

ব্যাংকের এফডিআর থাকায় এখনো টিকে রয়েছে উভয় স্টক এক্সচেঞ্জ। স্টক এক্সচেঞ্জ ২টির মধ্যে ডিএসইর ২০২২-২৩ অর্থবছরে নিট মুনাফা হয়েছে ৮০ কোটি ৬৩ লাখ টাকা বা ইপিএস ৪৫ পয়সা। আর সিএসইর হয়েছে ৩৪ কোটি ৫৩ লাখ টাকা বা ইপিএস ০.৫৪ টাকা।

ডিএসইর ২০২২-২৩ অর্থবছরে মোট আয় হয়েছে ২৩৮ কোটি ১৮ লাখ টাকা। এরমধ্যে লেনদেন থেকে আয় হয়েছে ৯৩ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। আর এফডিআর ও বন্ড থেকে সুদজনিত আয় হয়েছে ৬৮ কোটি ২০ লাখ টাকা ও সিডিবিএল থেকে ১০ কোটি ১৫ লাখ টাকা লভ্যাংশ আয় হয়েছে। এছাড়া ভবন ভাড়া থেকে ১২ কোটি ২১ লাখ টাকা ও নানাবিধ আয় আছে ৫ কোটি ৬৯ লাখ টাকা।

এই স্টক এক্সচেঞ্জটির পরিচালন ব্যয় হয়েছে ১২৫ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। যাতে পরিচালন মুনাফা হয়েছে ১১২ কোটি ৩০ লাখ টাকা।

এদিকে সিএসইর ২০২২-২৩ অর্থবছরে ব্যবসা পরিচালনার থেকে সুদজনিত আয় বেশি হয়েছে। এ স্টক এক্সচেঞ্জটির ২০২২-২৩ অর্থবছরে পরিচালন আয় হয়েছে ৩৫ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। আর সুদজনিত আয় হয়েছে ৩৬ কোটি ২০ লাখ টাকা। এ প্রতিষ্ঠানটির পরিচালন আয় থেকে পরিচালন মুনাফা হয়েছে মাত্র ৫ কোটি ৩৯ লাখ টাকা।

২০২২-২৩ অর্থবছর শেষে ডিএসইর এফডিআর রয়েছে ৮৬০ কোটি ৬২ লাখ টাকা। আর সিডিবিএলে ৮১ কোটি ৬৮ লাখ টাকা দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ করেছে। এছাড়া ক্লিয়ারিং ও সেটেলমেন্টের জন্য দীর্ঘদিনেও কার্যক্রম শুরু না হওয়া সেন্ট্রাল কাউন্টার পার্টি বাংলাদেশ লিমিটেডে (সিসিবিএল) ৪৫ শতাংশ মালিকানায় ১৩৫ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে।

সিএসইর ২০২২-২৩ অর্থবছরে শেষে এফডিআর রয়েছে ৪৩৬ কোটি ৭৩ লাখ টাকা। এছাড়া সিডিবিএলে বিনিয়োগ ৬১ কোটি ২৬ লাখ টাকা, সেন্ট্রাল কাউন্টার পার্টি বাংলাদেশ লিমিটেডে (সিসিবিএল) ৬০ কোটি টাকা ও বন্ডে ৫৮ কোটি ৯৬ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছে।

১ হাজার ৮০৩ কোটি ৭৮ লাখ টাকা পরিশোধিত মূলধনের ডিএসইতে নিট ১ হাজার ৯১৭ কোটি ৯৬ লাখ টাকার নিট সম্পদ রয়েছে। যা শেয়ারপ্রতি বিবেচনায় রয়েছে (এনএভিপিএস) ১০.৬৩ টাকা। আর ৬৩৪ কোটি ৫২ লাখ টাকা পরিশোধিত মূলধনের সিএসইতে নিট সম্পদ রয়েছে ৭৬১ কোটি ৮৩ লাখ টাকার বা এনএভিপিএস ১২.০১ টাকা।

পাঠকের মতামত:

শেয়ারবাজার এর সর্বশেষ খবর

শেয়ারবাজার - এর সব খবর



রে