ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

সাড়ে ৫ কোটি টাকার জমিতে ৪৯ কোটি টাকার ভূয়া উন্নয়ন ব্যয়

২০২৪ সেপ্টেম্বর ০২ ০৯:১৭:০৯
সাড়ে ৫ কোটি টাকার জমিতে ৪৯ কোটি টাকার ভূয়া উন্নয়ন ব্যয়

অর্থ বাণিজ্য প্রতিবেদক : শেয়ারবাজার থেকে অর্থ সংগ্রহ করতে কৃত্রিমভাবে সম্পদ বাড়িয়ে দেখায় লুব-রেফ বাংলাদেশ। এই কোম্পানি কর্তৃপক্ষ ৫ কোটি ৫০ লাখ টাকার জমিতে ৪৯ কোটি ৩৬ লাখ টাকার উন্নয়ন কাজ করা হয় বলে দাবি করে। তবে কোম্পানিটির সরেজমিনে পরিদর্শনে তা পাওয়া যায়নি। চট্টগ্রাম শহরে ১০০ শতাংশ জমির পুরোটার উপরে কোম্পানিটির অফিস ও কারখানা। যেখানে প্রাচীর ও ভেতরে হাটার মতো রাস্তা ছাড়া উন্নয়ন ব্যয়ের সুযোগ নেই। আর নদীর পারে কারখানা করার জন্য কোম্পানিটির কিছু ধানী জমি কেনা আছে। যেখানে মাটি ফেলে কিছু অর্থ কাজে লাগানো হয়েছে।

এই দুইয়ের বাহিরে কোম্পানিটির বলার মতো জমি উন্নয়ন ব্যয় নেই। যেখানে ৫ কোটি টাকা ব্যবহার করা হয়নি। কিন্তু কোম্পানি কর্তৃপক্ষ সেটাকে ৪৯ কোটি ৩৬ লাখ টাকা দেখিয়ে নিজেদের সম্পদ বাড়িয়েছে। এর মাধ্যমে শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদেরকে আকৃষ্ট করা হয়েছে। এই অবস্থার মধ্য দিয়েই কোম্পানিটিকে আইপিও অনুমোদনের মাধ্যমে বিএসইসি ১৫০ কোটি টাকা তুলে নিয়ে যেতে দিয়েছে।

তবে একই কমিশন এসএফ টেক্সটাইলের আইপিও আবেদন বাতিলের কারন হিসাবে ১১.৬৫ কোটি টাকার জমিতে ২৪.২৫ কোটি টাকার উন্নয়ন ব্যয়কে অস্বাভাবিক বলে কারন দেখায়। সেই তুলনায় লুব-রেফে আরও বেশি অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটেছে। জমির দলিল সাবমিট করানোর প্রয়োজন পড়ায় এক্ষেত্রে প্রতারনার সুযোগ থাকে না। যে কারনে উন্নয়ন নিয়ে প্রতারণা করা হয়। এখানে উন্নয়ন বাবদ ব্যয় দেখিয়ে পরিচালকদের মালিকানা বাড়ানো হয়।

তবে বিএসইসির বর্তমান চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদের নেতৃত্বাধীন কমিশন অবশ্য বিতর্কিত আইপিওর কোম্পানিগুলোর বিষয়ে তদন্ত শুরু করেছে।এরইমধ্যে ৫ সদস্যের বিশেষ কমিটি গঠন করা হয়েছে। যারা প্রাথমিক পর্যায়ে বেস্ট হোল্ডিংস, একমি পেস্টিসাইডস, রিং শাইন, কপারটেক ইন্ডাস্ট্রিজের মতো কোম্পানিগুলো নিয়ে কাজ করবে।

লুব-রেফ বাংলাদেশ নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদনের ১ম পর্ব তুলে ধরা হল আজ।

(চট্টগ্রাম শহরে লুব-রেফের কারখানা ও অফিসের জায়গা রাস্তার সমান্তরাল জমিতে)

বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) এক নির্বাহি পরিচালক অর্থ বাণিজ্যকে বলেন, লুব-রেফ বাংলাদেশ প্রিমিয়াম পাওয়ার যোগ্য ছিল না। কৃত্রিম সম্পদ দেখিয়ে বুক বিল্ডিংয়ে এসেছে। এছাড়াও আরও অনেক সমস্যা রয়েছে। আইপিওকালীন সময়ই বোঝা গিয়েছিল কোম্পানিটি ২-৪ বছর পর লভ্যাংশ দিতে পারবে না। যার আলামত আরো আগে থেকে পাওয়া যাচ্ছে। এরইমধ্যে কোম্পানির ঘোষিত লভ্যাংশ না পেয়ে অনেক শেয়ারহোল্ডার বিএসইসিতে অভিযোগ করেছে।

জমি উন্নয়ন দেখাতে গিয়ে বড় প্রতারণার আশ্রয় নেয় লুব-রেফ কর্তৃপক্ষ। তারা কোম্পানিটির উন্নয়ন কাজের মধ্যে ৩.৫৩ কোটি টাকার ইট, ৪.২৯ কোটি টাকার সিমেন্ট, ৪.৬৪ কোটি টাকার লোহা ব্যবহার করার কথা বলে। এছাড়া উন্নয়ন করতে পাইলিংয়ে ৩.১০ কোটি টাকা ও ৩.৩৪ কোটি টাকার শ্রমিক ব্যয় হয়েছে বলে জানিয়েছে। যার বাস্তবে কোন অস্তিত্ব ছিল না।

এমনকি কোম্পানির প্রদত্ত কৃত্রিম উন্নয়ন ব্যয়েও হিসাব মান লঙ্ঘন করা হয়েছে। তাদের দেখানো উন্নয়ন ব্যয়ের মধ্যে- ইট, লোহা, সিমেন্ট অবচয়যোগ্য। এছাড়া প্রসপেক্টাসের ৯৫ পৃষ্টায় ইট দিয়ে প্রাচীর নির্মাণের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। যেটাও অবচয়যোগ্য। কিন্তু কোম্পানি কর্তৃপক্ষ অবচয় চার্জ করেনি। এর মাধ্যমে কোম্পানি কর্তৃপক্ষ নিয়মিতভাবে মুনাফা ও সম্পদ বেশি দেখিয়ে আসছে।

বিএসইসি’র সাবেক অফিস অব দ্য চীফ অ্যাকাউন্টেন্ট, কনসালটেন্ট মো. মনোয়ার হোসেন (এফসিএমএ, সিপিএ, এফসিএ, এসিএ) বলেন, অ্যাকাউন্টিং স্টান্ডার্ড অনুযায়ি প্রাচীর ও রাস্তা জাতীয় ল্যান্ড ডেভোলপমেন্টের উপর অবচয় চার্জ করতে হবে। অন্যথায় মুনাফা ও সম্পদ বেশি দেখানো হবে। যা বিনিয়োগকারীদের মাঝে ভুল তথ্য প্রদান করা হবে।

লুব-রেফের জমি রিভ্যালুয়েশন করেছে প্রতারনার দায়ে অভিযুক্ত ও নিরীক্ষা কাজে নিষিদ্ধ আহমেদ অ্যান্ড আক্তার নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান। ওই রিভ্যালুয়েশনের মাধ্যমে লুব-রেফের ৫১ কোটি ২৮ লাখ টাকার জমি এখন ৫৬ কোটি ২৪ লাখ টাকা বাড়িয়ে দেখানো হচ্ছে। এমন একটি প্রতারক নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানের রিভ্যালুয়েশনের সঠিকতা নিয়ে ডিএসই প্রশ্ন তুলেছে।

আহমেদ অ্যান্ড আক্তার একটি কোম্পানির ভূয়া আর্থিক হিসাবকে সঠিক বলে সনদ দেয়। যা পরবর্তিতে ডিএসইর মাধ্যমে আলোচনায় উঠে আসে। এর আলোকে ফিন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং কাউন্সিল (এফআরসি) তদন্তের উদ্যোগ নেয়। তাদের নির্দেশে আইসিএবি আর্থিক হিসাবের সত্যতা যাচাইয়ে নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানটির কাছে নিরীক্ষা কাজের ‘অডিট ওয়ার্কিং পেপার’ চাইলেও তারা না দিয়ে অসহযোগিতা করে। যে কারনে প্রতিষ্ঠানটিকে নিরীক্ষা কাজের অনুমোদন নবায়ন করে না আইসিএবি। এছাড়া শেয়ারবাজারের কোম্পানি নিরীক্ষায় যৌথ মালিকানার (পার্টনারশিপ) নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান হওয়া বাধ্যতামূলক হলেও আহমেদ অ্যান্ড আক্তার প্রতারণা করে। এই প্রতিষ্ঠানটির পার্টনার শাহেদ মোহাম্মদের অবসরের কারণে নীরিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি পার্টনারশিপ থেকে একক মালিকানার পরিণত হলেও তা আড়াল করে। যা পরবর্তিতে প্রকাশের মাধ্যমে বিএসইসি শেয়ারবাজারে প্রতিষ্ঠানটিকে নিষিদ্ধ করে।

এ বিষয়ে জানতে লুব-রেফ বাংলাদেশের প্রধান অর্থ কর্মকর্তা (সিএফও) মফিজুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।

উল্লেখ্য, লুব-রেফ ২০০১ সালের ১৮ নভেম্বর পাবলিক কোম্পানি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। যার বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন শুরু হয় ২০০৬ সালে।

পাঠকের মতামত:

শেয়ারবাজার এর সর্বশেষ খবর

শেয়ারবাজার - এর সব খবর



রে