ঢাকা, সোমবার, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১ আশ্বিন ১৪৩১

স্বাধীন পরিচালক নিয়োগ নিয়ে বিএসইসি-ডিএসইর দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে

২০২৪ সেপ্টেম্বর ০৮ ০৯:০৫:০২
স্বাধীন পরিচালক নিয়োগ নিয়ে বিএসইসি-ডিএসইর দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে

অর্থ বাণিজ্য প্রতিবেদক : আগে থেকেই স্বাধীন বা স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগে স্বাধীনতা নেই দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) কর্তৃপক্ষের। যা শেখ হাসিনা সরকারের পদত্যাগে দেশের পরিস্থিতির পরিবর্তনের মাধ্যমেও পরিবর্তন হয়নি। বরং ঘটেছে নজিরবিহীন ঘটনা। আগে ডিএসই কর্তৃপক্ষ কয়েকজন নিজেদের পছন্দের স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ দিতে পারলেও এবার সবগুলোই এককভাবে দিয়েছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। যা আবার দেওয়া হয়েছে আইন ভেঙ্গে। এছাড়া স্বাধীন পরিচালক নিয়োগে যথারীতি ডিএসই কর্তৃপক্ষ অপমান করা হয়েছে। এনিয়ে বিএসইসি ও ডিএসইর দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে উঠে এসেছে।

স্বাধীন পরিচালক নিয়োগে ডিএসই কর্তৃপক্ষকে অপমান ও আইন ভঙ্গ, এর জেরে ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ডিবিএ) বিএসইসিকে চিঠি এবং বিএসইসি চেয়ারম্যানের সাক্ষাত চেয়ে ডিএসই কর্তৃপক্ষ সময় চেয়েছেন। আনুষ্ঠানিকভাবে ডিবিএ ও ডিএসই চিঠি দিলেও বিএসইসির এককভাবে স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ নিয়ে ডিএসইর ট্রেকহোল্ডাররা খুবই ক্ষুব্ধ। এ নিয়ে তারা বিভিন্ন পর্যায়ে আলাপ-আলোচনা করছেন এবং বিএসইসির বিরুদ্ধে করণীয় নিয়ে ভাবছে।

এতে করে খন্দকার রাশেদ মাকসুদের নেতৃত্বাধীন কমিশনের শুরুতেই বিএসইসি ও ডিএসইর দ্বন্দ প্রকাশ্যে উঠে এসেছে। যা শেয়ারবাজারের জন্য খুবই খারাপ দিক বলে মনে করছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, এর আগে বিগত কমিশনের সময় শুরুতেই এমন দ্বন্দ দেখা যায়নি। কমিশন আসার পরে সময়ের ব্যবধানে স্বার্থগত কারনে দ্বন্দ হয়েছে। কিন্তু কোন কমিশনের শুরুতেই বর্তমানের মতো দেখা যায়নি। এতে করে শেয়ারবাজারে খারাপ তথ্য গেল। যা বাজারের জন্য ক্ষতিকর।

গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পরে ১০ আগস্ট বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম পদত্যাগ করেন। এর ২দিন পরে ১২ আগস্ট পদত্যাগ করেন কমিশনার অধ্যাপক ড.শামসুদ্দিন আহমেদ ও ড. রুমানা ইসলাম। এরপরে গত ১৮ আগস্ট খন্দকার রাশেদ মাকসুদকে চেয়ারম্যান এবং ২৮ আগস্ট মো. আলী আকবরকে ও ৩ সেপ্টেম্বর ফারজানা লালারুখ বিএসইসির কমিশনার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

খন্দকার রাশেদ মাকসুদের নেতৃত্বাধীন কমিশনের এই অল্প সময়ের মধ্যেই বিএসইসি ও ডিএসইর দ্বন্দ্ব ফুটে উঠেছে। যার সূত্রপাত্র স্বাধীন পরিচালক নিয়োগ দেওয়া নিয়ে।

সরকারের পতনের পরে ডিএসইর তল্পিবাহক স্বাধীন পরিচালকেরা পদত্যাগ করে। এরপরে শুন্যপদে পরিচালক নিয়োগে বিএসইসির চাহিদার আলোকে গত ১ সেপ্টেম্বর স্বাধীন পরিচালক নিয়োগে নামের তালিকা জমা দেয় ডিএসই কর্তৃপক্ষ। তবে একইদিনে সেটাকে ছুঁড়ে ফেলে নিজেদের মতো করে মাজেদের মতো বিতর্কিত ব্যক্তিকে আইন ভেঙ্গে চেয়ারম্যান করে ৭জনের স্বাধীন নামের পরাধীন পর্ষদ নিয়োগ দিয়েছে বিএসইসি।

আরও পড়ুন....

পরিচালক নিয়োগে জটিলতা : নির্দেশনা চেয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ে বিএসইসির চিঠি

এবার হেলাল উদ্দিনকে ডিএসইর স্বাধীন পরিচালক নিয়োগ নিয়ে বিতর্ক

স্বাধীন পরিচালক নিয়োগে ডিমিউচ্যুয়ালাইজেশন আইন পরিপালনের আহ্বান

ডিএসইতে বিএসইসির এককভাবে স্বাধীন পরিচালক চাপিয়ে দেয়া নজিরবিহীন

ডিএসইতে স্বাধীন পরিচালক নিয়োগে আইনের পরিপালন নিয়ে বিতর্ক

স্বাধীন পরিচালক নিয়োগে স্বাধীনতা নেই ডিএসইর

এ বিষয়ে ডিএসইর এক পরিচালক অর্থ বাণিজ্যকে বলেন, স্বাধীন পরিচালক নিয়োগে ডিএসইর মতামতকে কোন গুরুত্ব না দেওয়ায় শেয়ারহোল্ডার পরিচালকেরা এবং শেয়ারহোল্ডাররা খুবই হতাশ। এরমধ্যে বড় হতাশার কারন হচ্ছে স্বাধীন পরিচালক নিয়োগে বিএসইসি থেকেই নাম চেয়েছিল, আমরা দেওয়ার পরে তারা সেটাকে অবমূল্যায়ন করেছে। এতে করে শেয়ারহোল্ডারদের কাছে আমাদের আরভাবমূর্তিথাকল না।

তিনি বলেন, বিএসইসি চেয়ারম্যানের সঙ্গে আলাপে তিনি স্বাধীন পরিচালক নিয়োগে নাম দিতে বলেছিলেন। যা দিতে দেরি হওয়ায় বিএসইসির এক নির্বাহি পরিচালক যোগাযোগ করে নাম দেওয়ার তাগাদা দেন। এরপর দেওয়া হয়। কিন্তু বিএসইসি আমাদেরকে কোন মূল্যায়ন করল না। অথচ আমরা ২৫০ জন ট্রেকহোল্ডারর ও চীনা কৌশলগত বিনিয়োগকারী ডিএসইর শতভাগ মালিকানায়। তারপরেও তারা যদি নিজেদের মতো করেই নিয়োগ দেবে, তাহলে আমাদের কাছে নাম না চাইলেই পারত।

শুধু নিয়োগেই থেমে থাকেনি বিএসইসি। যাদেরকে ডিএসইতে নিয়োগ দিয়েছে, সেখানে আইন পরিপালন করেনি বলে বিতর্ক উঠেছে। নিয়োগ দেওয়া ৭ জন স্বাধীন পরিচালকের মধ্যে অন্তত্ব ৩ জনের নিয়োগ নিয়ে এই বিতর্ক উঠেছে।

ডিএসইর চেয়ারম্যান করতে চাওয়া কে এ এম মাজেদুর রহমান, ড. মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের অতিরিক্ত সচিব ডক্টর নাহিদ হোসেনকে নিয়োগে আইনের ব্যত্যয় হয়েছে বলে বিতর্ক উঠেছে।

ডিএসই রেগুলেশন, ২০১৩ এর ৫ ধারার ‘এফ’ উপধারায় বলা আছে, স্টক এক্সচেঞ্জের কোন ট্রেকহোল্ডার বা শেয়ারহোল্ডারের সঙ্গে সর্ম্পৃক্ত আছে বা ছিল, এমন কেউ ডিএসইর স্বাধীন পরিচালক হতে পারবেন না। এছাড়া ‘জি’ উপধারায় বলা হয়েছে, শেয়ারবাজার মধ্যস্থতাকারী কোন প্রতিষ্ঠানে (মার্চেন্ট ব্যাংক ও অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিসহ) সর্বশেষ ৩ বছরের মধ্যে কর্মী বা পরিচালক হিসেবে জড়িত থাকা কেউ স্বাধীন পরিচালক হতে পারবেন না। এছাড়া (জে) উপধারায় বলা হয়েছে, কোন নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানের কোন কর্মী ডিএসইর স্বাধীন পরিচালক হতে পারবেন না।

এমনকি ডিমিউচ্যুয়ালাইজেশন স্কীমের ৪.২ এর (ই) এর ৬-এ বলা হয়েছে, স্টক এক্সচেঞ্জের কোন ট্রেকহোল্ডার বা শেয়ারহোল্ডারের সঙ্গে সর্ম্পৃক্ত আছে বা ছিল, এমন কেউ ডিএসইর স্বাধীন পরিচালক হতে পারবেন না। ৭-এ বলা হয়েছে, শেয়ারবাজার মধ্যস্থতাকারী কোন প্রতিষ্ঠানে (মার্চেন্ট ব্যাংক ও অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিসহ) সর্বশেষ ৩ বছরের মধ্যে কর্মী বা পরিচালক হিসেবে জড়িত থাকা কেউ স্বাধীন পরিচালক হতে পারবেন। এছাড়া ১০-এ বলা হয়েছে, কোন নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানের কোন কর্মী ডিএসইর স্বাধীন পরিচালক হতে পারবেন না।

এমন বিধান থাকার পরেও কে এ এম মাজেদুর রহমান, ড. মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের অতিরিক্ত সচিব ডক্টর নাহিদ হোসেনকে স্বাধীন পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে বিএসইসি। যেখানে মাজেদুর রহমান ও ড. মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন সর্বশেষ ৩ বছরের মধ্যে শেয়ারবাজারের মধ্যস্থতাকারী ডিএসইর ট্রেকহোল্ডার প্রতিষ্ঠানে জড়িত ছিল।

এরমধ্যে মাজেদুর রহমান একে খান সিকিউরিটিজে ২০২০ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পরিচালক পদে ছিলেন। আর ড. মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন ২০১৩ সালের মে মাস থেকে ২০২২ সালের মে মাস পর্যন্ত ডিএসইর ট্রেকহোল্ডার আইসিবি সিকিউরিটিজ ট্রেডিং কোম্পানিতে পরিচালক পদে ছিলেন।

আর বিএসইসি যে মন্ত্রণালয়ের অধীনে, সেই অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে কর্মরত রয়েছেন অতিরিক্ত সচিব ডক্টর নাহিদ হোসেন। যদিও বিএসইসি একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান বলা হয়। কিন্তু দেশের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। অর্থমন্ত্রণালয় বিএসইসির যেকোন বিষয়েই হস্তক্ষেপ করতে পারে এবং অতিতে করেছে।

এই বিতর্কের মধ্যে মাজেদুর রহমানের নিয়োগ জটিলতা নিয়ে দিকনির্দেশনা চেয়ে গত ৪ সেপ্টেম্বর বিএসইসির নির্বাহি পরিচালক মো: আনোয়ারুল ইসলাম সাক্ষরিত এ সংক্রান্ত চিঠি অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিবের কাছে পাঠানো হয়েছে। এখানেও প্রশ্ন উঠেছে ডিএসইর ট্রেকহোল্ডারদের মধ্যে। তারা বলছে, যাদের কাছে বিএসইসি দিকনির্দেশনা চেয়েছে, তাদেরই অতিরিক্ত সচিবকে ডিএসইর পর্ষদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এখন নির্দেশনা তারা কিভাবে বিরুদ্ধে দেবে। আর বিএসইসি যে বলে অর্থ মন্ত্রণালয় তাদের রেগুলেটর প্রতিষ্ঠান না, তাহলে তাদের কাছে বিএসইসি কিভাবে দিকনির্দেশনা চাইল। তারাতো আইন মন্ত্রণালয়ে চাইতে পারত। আইনের বিষয় যেহেতু, সেহেতু আইন মন্ত্রণালয় সবচেয়ে উপযুক্ত ছিল।

ডিএসইর স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ নিয়ে কয়েক দফায় বিএসইসিকে চিঠি দিয়েছে ডিবিএ। তারা বিএসইসির নিয়োগের মাধ্যমে নজিরবিহীন ঘটনা ঘটেছে বলে জানিয়েছে। একইসঙ্গে ডিমিউচ্যুয়ালাইজেশন আইন পরিপালনের আহ্বান জানিয়েছে।

ডিএসইর স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ নিয়ে বিতর্কের বিষয়ে বিএসইসির পরিচালক ও মূখপাত্র ফারহানা ফারুকী অর্থ বাণিজ্যকে বলেন, কমিশন দেখে শুনে ডিএসইর সব স্বতন্ত্র পরিচালককে নিয়োগ দিয়েছে। এই নিয়োগে কোনো আইনের ব্যত্যয় ও স্বার্থের সংঘাত (কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট) হয়েছে বলে কমিশন মনে করে না।

পাঠকের মতামত:

শেয়ারবাজার এর সর্বশেষ খবর

শেয়ারবাজার - এর সব খবর



রে