ঢাকা, মঙ্গলবার, ৮ অক্টোবর ২০২৪, ২২ আশ্বিন ১৪৩১

জুতা ব্যবসা থেকে শেয়ারবাজারে কারসাজির হাতিয়ার

২০২৪ অক্টোবর ০১ ০৮:৩৯:৩৫
জুতা ব্যবসা থেকে শেয়ারবাজারে কারসাজির হাতিয়ার

শেয়ারবাজারে স্বাভাবিক ব্যবসা ও মুনাফা করা ফরচুন সুজ হঠাৎ করে আলোচনায় উঠে আসে হিরু চক্রের কারসাজির মাধ্যমে। কোম্পানিটির ব্যবসায় আহামরি কিছু না হলেও প্রাথমিক গণপ্রস্তাবে ১০ টাকা করে শেয়ার ইস্যু করা কোম্পানিটির শেয়ার দর অল্পসময়ে ১০০ টাকার উপরে উঠে যায়। এতে কারসাজিকারদের সঙ্গে বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম ও কোম্পানির কর্তা ব্যক্তিরা সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। একইভাবে সহযোগিতার অংশ হিসেবে ফরচুন সুজ থেকে কোটি কোটি টাকার বিনিয়োগ করা হয় ওইসব কারসাজিকারদের আইটেমে। যারা কারসাজিতে একে অপরের সহযোগি হিসেবে কাজ করেছে। যে কোম্পানিটির বিরুদ্ধে শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ না দেওয়া ও ভূয়া সম্পদ দেখানোর অভিযোগ রয়েছে।

এসবের কারনে গত ১ সেপ্টেম্বর খন্দকার রাশেদ মাকসুদের নেতৃত্বাধীন বিএসইসি ফরচুন সুজ লিমিটেড সংক্রান্ত শেয়ারবাজারের যাবতীয় অনিয়ম ও কারসাজি, বিনিয়োগকারীদের মধ্যে লভ্যাংশ বিতরণ সংক্রান্ত অনিয়ম এবং কোম্পানিটির শেয়ার মূল্য বৃদ্ধির সাথে জড়িত ব্যক্তিবর্গ ও প্রতিষ্ঠানসমূহের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান ও তদন্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

প্রাথমিক গণপ্রস্তাবে (আইপিও) শেয়ার ছেড়ে ২০১৬ সালে কোম্পানিটি শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। বরিশাল বিসিকে জুতা তৈরির এ কোম্পানি আইপিওতে প্রতিটি শেয়ার বিক্রি করে ১০ টাকা অভিহিত মূল্য বা ফেসভ্যালুতে। আইপিওর মাধ্যমে কোম্পানিটি ২২ কোটি টাকা সংগ্রহ করে। এ কোম্পানিটির শেয়ার দর ২০১৯ সালের ২২ অক্টোবর থেকে ২০২১ সালের ২২ এপ্রিলের আগপর্যন্ত ৩০ টাকার মধ্যে ঘুরপাক খেয়েছে। তবে ২২ এপ্রিলের পর তা টানা বাড়তে শুরু করে। যার পেছনে কোন কারন খুজে পায় না ডিএসই কর্তৃপক্ষ।

দেখা যায়, ২০২১ সালের মাত্র ছয় মাসে ৫০০ শতাংশ শেয়ার দর বাড়ে ফরচুন সুজের। ২০২১ সালের ২২ এপ্রিল কোম্পানিটির শেয়ারের দাম ছিল মাত্র ১৮ টাকা। একই বছরের ২১ অক্টোবর সেই দাম বেড়ে দাঁড়ায় ১০৫ টাকায়। তাতে ছয় মাসে কোম্পানিটির শেয়ারের দাম বাড়ে প্রায় ৫ গুণ।

কারসাজিকারদের স্বার্থ হাসিল শেষে শেয়ারটি এখন ২০ টাকার নিচে নেমে এসেছে। এতে করে হিরু চক্রের কবলে নিঃশ্ব হয়েছে হাজারো বিনিয়োগকারী।

(শেষ ২ বছরে দর পতনের চিত্র)

শেয়ার কারসাজি :

শেয়ারবাজারে কারসাজির আলোচিত কোম্পানি ফরচুন সুজ। এ কোম্পানিটির শেয়ার নিয়ে যেমন কারসাজি হয়েছে, একইভাবে এই কোম্পানি থেকেও কারসাজিকারদের শেয়ার কিনে কারসাজি করা হয়েছে। অনেকটা কারসাজিকর ও কোম্পানির মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতায় কারসাজি পায় ভিন্ন মাত্রা। এক্ষেত্রে ফরচুন সুজের শেয়ার নিয়ে কারসাজির দায়ে হিরু চক্রকে জরিমানা করা হলেও, কোম্পানিটিকে কখনো করা হয়নি।

দেখা গেছে, ২০২১ সালের ২০ মে থেকে ১৭ জুন পর্যন্ত সময়ে ফরচুন সুজ লিমিটেডের শেয়ার কারসাজির মাধ্যমে ৬ কোটি ১৩ লাখ টাকার মূলধনি মুনাফা অর্জন করেন আবুল কালাম মাতবর ও তার সহযোগীরা। ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানও এ সময়ে কোম্পানিটির উল্লেখযোগ্য পরিমাণ শেয়ার কিনেছিলেন। ফরচুন সুজের শেয়ার কারসাজিতে সংশ্লিষ্টতার কারণে আবুল কালাম মাতবর ও তার সহযোগীদের ২০২২ সালের ৬ জুলাই ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা জরিমানা করে বিএসইসি।

অথচ হিরু চক্রের অন্যতম সহযোগি বা অংশীদার ফরচুন সুজ। হিরু চক্র যেসব কোম্পানির শেয়ার নিয়ে কারসাজি করেছে, সেগুলোর মধ্যে অন্যতম আইপিডিসি, জেনেক্স ইনফোসিস, সোনালি পেপার, এনআরবিসি ব্যাংক, বিডিকম অনলাইন, ওয়ান ব্যাংক, এশিয়া ইন্স্যুরেন্স, গ্রিন ডেল্টা ইন্স্যুরেন্স, ঢাকা ইন্স্যুরেন্স ও বাংলাদেশ ন্যাশনাল ইন্স্যুরেন্স। এর মধ্যে আইপিডিসি, জেনেক্স ইনফোসিস, সোনালি পেপারে ফরচুন সুজ থেকে বিনিয়োগ করা হতো। যাতে সবাই মিলে শেয়ারগুলোকে অতিমূল্যায়িত করত।

দেখা গেছে, ফরচুন সুজ থেকে ২০২২ সালের ৩০ জুন শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ দাঁড়ায় ৩২ কোটি ৪০ লাখ টাকা। এরমধ্যে জেনেক্স ইনফোসিসে ৫০ হাজার, আইপিডিসিতে ৪ কোটি ৩৪ লাখ টাকা এবং সোনালি পেপারে ২৮ কোটি ৫ লাখ টাকা বিনিয়োগ করা হয়।

এরপরে ২০২৩ সালের ৩০ জুনও ফরচুন সুজ থেকে হিরু চক্রের সহযোগিতার অংশীদার হিসেবে আইপিডিসি ও সোনালি পেপারে বড় বিনিয়োগ ছিল কোম্পানিটির। ওইসময় ফরজুন সুজের শেয়ারবাজারে ৩৫ কোটি ৪৪ লাখ টাকা বিনিয়োগ ছিল। এরমধ্যে আইপিডিসিতে ৩২ কোটি ৮৩ লাখ টাকা ও সোনালি পেপারে ২ কোটি ৬০ লাখ টাকা বিনিয়োগ ছিল।

সংঘবদ্ধ চক্রটির মধ্যে শেয়ার কারসাজির বাহিরেও সর্ম্পক্য :

ফরচুন সুজ, সাকিব আল হাসান, আবুল খায়ের হিরু, জেনেক্স ইনফোসিস একটি সংঘবদ্ধ চক্র। এরা সম্মিলিতভাবে শেয়ার কারসাজি করে। এর বাহিরে বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লীগ নিয়ে কারসাজিকারদের মধ্যে একটি সর্ম্পক্য রয়েছে।

২০২১ সালের ডিসেম্বর ‘ফরচুন বরিশাল’ দলের অফিশিয়ালি মালিকানা অর্জন করে ফরচুন গ্রুপ অব কোম্পানিজের চেয়ারম্যান মো. মিজানুর রহমান। যিনি ২০২২ সালে অনুষ্ঠিত বিপিএল ক্রিকেটে ফরচুন বরিশাল দলের নেতৃত্ব দিতে কারসাজির সহযোগি সাকিব আল হাসানকে দলে নেন। সাকিবের ব্যবসায়িক পার্টনার হিরু। অন্যদিকে বিপিএলে ফরচুন বরিশালের বড় বিজ্ঞাপন দাতা জেনেক্স ইনফোসিস।

কোটি কোটি টাকার সম্পদের সত্যতা নেই :

ফরচুন সুজের ২০২২-২৩ অর্থবছরের আর্থিক হিসাবে ৯৩ কোটি ৬০ লাখ টাকার স্থায়ী সম্পদ দেখায়। কিন্তু নিরীক্ষক ওই সম্পদের সত্যতা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। সঠিক ও পূর্ণাঙ্গ ফিক্সড অ্যাসেট রেজিস্টার না থাকায় নিরীক্ষক এই শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। এছাড়া ৮৭ কোটি ৭৫ লাখ টাকার মজুদ পণ্য ও ১৪৪ কোটি ৭৯ লাখ টাকার বিক্রিত পণ্যের ব্যয়ের (কস্ট অব গুড সোল্ড) সত্যতা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। যে হিসাবগুলোতে ভুল তথ্য দেওয়া এবং সম্পদের অস্তিত্ব না থাকার ঝুঁকি রয়েছে বলে জানিয়েছে নিরীক্ষক।

লভ্যাংশ না দেওয়া :

লভ্যাংশ ঘোষণার পরেও ফরচুন সুজ লিমিটেড থেকে প্রাপ্য লভ্যাংশ না পাওয়ায় ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) অভিযোগ করে বিনিয়োগকারীরা। বিনিয়োগকারীদের পক্ষে লংকাবাংলা সিকিউরিটিজ লিখিতভাবে এ অভিযোগ দায়ের করে।

জানা গেছে, ২০২১-২২ অর্থবছরের জন্য ১০% নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করে ফরচুন সুজ লিমিটেড। যার রেকর্ড ডেট ছিলো ২০২২ সালের ২৪ নভেম্বর। তবে কোম্পানি কর্তৃপক্ষ লভ্যাংশ বিতরনের নির্দিষ্ট সময় শেষেও শেয়ারহোল্ডাররা তা দেয়নি। ফলে বিনিয়োগকারীদের বিও হিসাব পরিচালিত লংকাবাংলা সিকিউরিটিজেক চাপ প্রয়োগ করে। লভ্যাংশ না পাওয়া অভিযোগকারীদের হিসাব অনুযায়ী শুধু লংকাংবাংলা সিকিউরিটিজই পাবে ৩০ লাখ ৪৫ হাজার টাকা। তবে গত ৯ জুন ২০২১-২২ অর্থবছরের ব্যবসার লভ্যাংশ প্রেরণ করেছে বলে ডিএসইতে জানিয়েছে ফরচুন সুজ কর্তৃপক্ষ।

কিন্তু এরপরে ২০২২-২৩ অর্থবছরের ব্যবসায় কোম্পানিটির পর্ষদ ৫% নগদ লভ্যাংশ ঘোষনা করেছিল। যা ২০২৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর কোম্পানির এজিএমে অনুমোদিত হয়েছে। তারপরেও ওই লভ্যাংশ এখন পর্যন্ত বিতরন করেনি ফরচুন সুজ কর্তৃপক্ষ।

শ্রমিক অসন্তোষ :

গত ২৩ মে দুপুরে বরিশাল বিসিকে অবস্থিত ফরচুন সুজ কারখানায় কাজে যোগ দিয়ে মার্চ ও এপ্রিল মাসের বেতন দাবি করেন শ্রমিকরা। তবে ফরচুন কারখানা কর্তৃপক্ষ জানায়, পুরো বেতন পরিশোধ করা সম্ভব নয়। এই খবর শুনে কিছু শ্রমিক কাজে ইস্তফা দিয়ে কারখানা থেকে বেরিয়ে যান। বেরিয়ে যাওয়া শ্রমিকদের মধ্যে কয়েকজনকে ধরে নিয়ে আনসার ক্যাম্পে মারধর করা হয়। এই খবর অন্য শ্রমিকরা পেলে তারা সংঘবদ্ধ হয়ে আনসার ক্যাম্পে ও ফরচুন কারখানায় হামলা চালায়। ঘটনার আকস্মিকতায় গুলি করেন আনসার সদস্যরা। এতে এখন পর্যন্ত অন্তত অর্ধশত আহত হওয়ার খবর পাওয়া যায়।

শ্রমিকদের ওই আন্দোলনের মুখে বকেয়া বেতন পরিশোধ করে ফরচুন সুজ লিমিটেড। ২৩ মে রাত ৯টার মধ্যে কারখানার প্রায় সাড়ে তিন হাজার শ্রমিককে বেতন দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে শ্রমিকদের উত্থাপিত অন্যান্য দাবি মেনে নেওয়ারও ঘোষণা দেয় কর্তৃপক্ষ। ওইদিনের ঘটনার প্রেক্ষিতে শুক্রবার কারখানা বন্ধ রাখার পর ২৫ মে পুলিশি পাহারায় পুনরায় চালু করা হয় জুতা রপ্তানিকারক এই প্রতিষ্ঠানটি।

এসব বিষয়ে জানতে ফরচুন সুজের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান ও সচিব রিয়াজ উদ্দিন ভূইয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তারা কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি।

পাঠকের মতামত:

শেয়ারবাজার এর সর্বশেষ খবর

শেয়ারবাজার - এর সব খবর



রে