ঢাকা, সোমবার, ৭ অক্টোবর ২০২৪, ২২ আশ্বিন ১৪৩১

দক্ষতার অভাবে বিএসইসিতে নজিরবিহীন ঘটনা-ক্রোন্দল : ফিরছে না আস্থা

২০২৪ অক্টোবর ০২ ০৮:৩৮:৫২
দক্ষতার অভাবে বিএসইসিতে নজিরবিহীন ঘটনা-ক্রোন্দল : ফিরছে না আস্থা

অর্থ বাণিজ্য প্রতিবেদক : গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের মাধ্যমে দেশের পট পরিবর্তন হয়েছে। এরইমধ্যে নোবেলজয়ী ড. ইউনুসকে প্রধান করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নিয়ে বিভিন্ন খাতে পরিবর্তন এনেছে। যার ধারাবাহিকতায় শেয়ারবাজারেও সংস্কার করা হয়েছে। কিন্তু তারপরেও থেমে নেই এই বাজারে সমস্যার। একের পর এক সমস্যা তৈরী হচ্ছে। যেখানে অর্থ উপদেষ্টার নাম ভাঙ্গিয়ে আওয়ামীলীগের অনেক সুযোগ-সুবিধা ভোগী অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের একজন অতিরিক্ত সচিবের ব্যক্তিগত স্বার্থে ষড়যন্ত্র করার মতো নজিরবিহীন ঘটনাও ঘটেছে। এছাড়া বিএসইসিতে নির্বাহি পরিচালক ও কমিশনারকে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করার মতো বিরল ঘটনা ঘটেছে। আর ডিএসইতে স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ নিয়ে একের পর এক ড্রামার জন্ম দিয়ে যাচ্ছে বিএসইসি। এসব কারনে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরছে না।

শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। প্রতিষ্ঠানটির মধ্যে এখন বিরাজ করছে এক থমথমে অবস্থা। যাতে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ঠিকঠাক কাজ করতে পারছে না।

বিএসইসির সাম্প্রতিক ঘটনা নিয়ে ডিএসইর এক সিনিয়র ট্রেকহোল্ডার অর্থ বাণিজ্যকে বলেন, বিএসইসিতে যা হচ্ছে, তা নজিরবিহীন। ডিএসইতে স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ নিয়ে কয়েক দফায় যা করল, এটা ইতিহাস হয়ে থাকবে। এরপরে আবার বাজার মধ্যস্থতাকারীদের বাদ দিয়েই বিএসইসির চেয়ারম্যানের শেয়ারবাজারকে এগিয়ে নিতে চাওয়ার মতো মনোভাব বোঁকামি ছাড়া কিছু না। যে চেয়ারম্যান দায়িত্ব নেওয়ার পরে কমিশনার ও নির্বাহি পরিচালককে দপ্তরবিহীন করার মতো বিরল ঘটনা ঘটেছে। সব মিলিয়ে বর্তমান কমিশনের উপরে বিনিয়োগকারীদের আস্থা নেই। তাদেরকে শেয়ারবাজারের জন্য যোগ্যই মনে করছেন বাজার মধ্যস্থতাকারী থেকে শুরু করে বিনিয়োগকারীরা।

বিএসইসিতে অন্তঃকলহ :

শেয়ারবাজারের ইতিহাসে বিএসইসিতে চলছে নজিরবিহীন অন্তকলহ। এরইমধ্যে নিয়ন্ত্রক সংস্থাটিতে কয়েকটি গ্রুপ তৈরী হয়েছে। যাতে করে কমিশনার ড. তারিকুজ্জামান ও নির্বাহি পরিচালক সাইফুর রহমানকে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করার মতো ঘটনাও ঘটেছে বিএসইসিতে। এছাড়া বিএসইসির অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্রে টিকতে না পেরে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন কমিশনার ড. তারিকুজ্জামান। যাকে চাকরী থেকে শুরুতে ৩ মাসের সময় দিয়ে অব্যাহতি দেওয়া হয়।

ব্যাপক দূর্ণীতিতে জড়িত বিএসইসি কর্মকর্তারা :

বিএসইসির কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দূর্ণীতির অভিযোগ অনেক পুরাতন। তবে গত কয়েক বছরে বিএসইসির কর্মকর্তার দূর্ণীতিকে শৈল্পিক পর্যায়ে নিয়ে গেছে। যারা টাকা ছাড়া কাজই করতে চান না। এমনকি করোনার মধ্যে নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও এ তালিকায় ঢুকে পড়েছে। যারা ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে ১০-২০ হাজার টাকাও ঘুষ নেন। কেউ ঘুষ দিতে নাই চাইলে, তাদেরকে বিএসইসির এইসব নতুন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বলেন ‘সরকারি অফিস থেকে কাজ করতে হলে, কি করতে হয় জানা নেই নাকি’।

তবে বিএসইসির দূর্ণীতিতে কিছুটা লাগাম টানার চেষ্টায় দূর্ণীতি দমন কমিশন (দুদক)। এরইমধ্যে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সদ্য পদত্যাগ করা চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম এবং তার ৮ জন সহযোগী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে জালিয়াতি ও প্রতারনার অভিযোগে মানি লন্ডারিং শাখা অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

এই ৮জন সহযোগী কর্মকর্তা হচ্ছেন- সাবেক কমিশনার শেখ শামসুদ্দীন আহমেদ, নির্বাহী পরিচালক মোঃ মাহবুবুল আলম, নির্বাহী পরিচালক সাইফুর রহমান, নির্বাহী পরিচালক রেজাউল করিম, পরিচালক শেখ মাহবুবুর রহমান, পরিচালক মোঃ মাহমুদুল হক, অতিরিক্ত পরিচালক এস কে মোহাম্মদ লুৎফুল কবির ও যুগ্ন পরিচালক ও চেয়ারম্যানের একান্ত সহকারি মো. রাশিদুল আলম।

বাজার মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠানের এক শীর্ষ কর্মকর্তা অর্থ বাণিজ্যকে বলেন, পুলিশ ঘুষ নেয় বলে সবাই সমালোচনা করে। কিন্তু তাদের চেয়ে অনেক বেশি নেয় বিএসইসির কর্মকর্তারা। এরা যে কি পরিমাণ দূর্ণীতিতে জড়িত, তা সাধারন মানুষের কল্পনার বাহিরে। বিএসইসির কর্মকর্তাদের সম্পদের খোঁজখবর নিলেই বেরিয়ে আসবে। এরা প্রতিটা কাজের জন্য কেউ নগদ, কেউ শেয়ার ঘুষ নিয়ে থাকে।

ডিএসইতে স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগে দফায় দফায় ভুল :

শেয়ারবাজারে বিএসইসির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নিয়েই রাশেদ মাকসুদের নেতৃত্বাধীন কমিশন বড় বিতর্কের সৃষ্টি করে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) আইনে নিষিদ্ধ ব্যক্তিদের স্বতন্ত্র পরিচালক পদে নিয়োগ দিয়ে। এ বিষয়ে ২বার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেছে কমিশন। তারপরেও ঋণখেলাপিকে নিয়োগ দিয়েছে। বিষয়টি নিয়ে চারদিকে ব্যাপক সমালোচনা চলছে। এছাড়া ড. নাহিদ হোসেনকে নিয়োগের বিষয়টিও ব্যাপক সমালোচিত।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিএসইসির নতুন চেয়ারম্যানসহ কমিশন সদস্যদের বাজার সম্পর্কে ধারণা না থাকায় বারবার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে হচ্ছে। এতে বাজারে কমিশনের অদক্ষতা ফুটে উঠছে। আর অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, একই ভুল বারবার করলে তা গ্রহণযোগ্য নয়।

দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ১ সেপ্টেম্বর ডিএসইর পর্ষদে ৭ জন স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ দেয় বিএসইসি। এর মধ্যে ৩ জনের ক্ষেত্রেই আইন লঙ্ঘন হয়েছে। এরা হলেন-ডিএসইর সাবেক এমডি মাজেদুর রহমান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. হেলাল উদ্দিন আহমেদ ও ড. নাহিদ হোসেন। তবে বিতর্ক শুরু হলে ড. নাহিদ ছাড়া বাকি দুজন নিজ থেকেই সরে দাঁড়ান। এরপর ১৮ সেপ্টেম্বর এ দুজনের স্থানে নতুন দুজনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। এরা হলেন-হুদা ভাসী চৌধুরী অ্যান্ড কোম্পানির সিনিয়র পার্টনার এএফ নেসারউদ্দিন ও জেডএন কনসালট্যান্টের সিইও সৈয়দা জাকেরিন বখত নাসির। কিন্তু এখানেও আইনের ব্যত্যয় হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন উঠায় তারাও যোগ দেননি। তাদের জায়গায় নিয়োগ দেওয়া হয়েছে মোমিনুল ইসলাম ও শাহনাজ সুলতানাকে। এরমধ্যে মোমিনুল ইসলামের সিআইবিতে ঋণখেলাপির তথ্য উঠে এসেছে। যে কারনে তিনি ডিএসইর পর্ষদে যোগ্য দেওয়ার যোগ্যতা হারিয়েছেন।

স্টেকহোল্ডারদের অবজ্ঞা :

শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীদের পর মূল চালিকা শক্তি স্টক এক্সচেঞ্জ ও বাজার মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। তবে এদেরকে অবহেলা বা গোনায় না ধরে এগিয়ে যেতে চায় বিএসইসির রাশেদ মাকসুদের নেতৃত্বাধীন কমিশন। এরইমধ্যে বাজার মধ্যস্থতাকারীদেরকে সাক্ষাতে সময় না দেওয়া ও ডিএসইর স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ নিয়ে বিএসইসির সঙ্গে সবার বৈরী সর্ম্পক্য তৈরী হয়েছে।

রাশেদ মাকসুদের কমিশন বাজার মধ্যস্থতাকারীদেরকে সাক্ষাতে সময় দিতে গড়িমসি করে। পরে দিনক্ষণ দিলেও কোন কোন সংগঠনের সঙ্গে ৫-৭ মিনিট আলাপ করেছেন। যা লজ্জায় কারও সঙ্গে শেয়ার করতেও পারছেন না।

অন্যদিকে ডিএসইতে স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ দিয়ে বারবার ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশন থেকে চিঠি দেওয়া হলেও তা আমলে নেয়নি বিএসইসি। তারা নিজেদের মতো করে নিয়োগ দিয়েছে। তাদের একঘেয়েমির কারনে নিজেদের স্বতন্ত্র বা স্বাধীন পরিচালক নিয়োগেও স্বাধীনতা হারিয়েছে ডিএসই।

পাঠকের মতামত:

শেয়ারবাজার এর সর্বশেষ খবর

শেয়ারবাজার - এর সব খবর



রে