ঢাকা, সোমবার, ৩১ মার্চ ২০২৫, ১৭ চৈত্র ১৪৩১

তদন্ত কমিটির অনিয়মের তথ্য প্রত্যাহারে বিএসইসির কর্মকর্তাদের চাঁপ প্রয়োগ

২০২৫ মার্চ ২৭ ০৯:৪৬:০৫
তদন্ত কমিটির অনিয়মের তথ্য প্রত্যাহারে বিএসইসির কর্মকর্তাদের চাঁপ প্রয়োগ

অর্থ বাণিজ্য প্রতিবেদক : দেশের শেয়ারবাজারে বিগত সময়ের অনিয়ম, দুর্নীতি ও কারসাজির ঘটনা খতিয়ে দেখতে গত ২ সেপ্টম্বর পাঁচ সদস্যের একটি অনুসন্ধান ও তদন্ত কমিটি গঠন করেছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। যে কমিটি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে বিএসইসিরই কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। যারা কমিটির বিতর্কিত সদস্য ও অবৈধভাবে বেশি করে সম্মানি নেওয়ার বিষয়ে সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েছে। যা প্রত্যাহার করে নেওয়ার জন্য সম্প্রতি তদন্ত কমিটির সদস্যরা বিএসইসির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চাঁপ দেওয়া শুরু করেছেন।

গত ০৬ মার্চ বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষে সদস্য সচিব ও অতিরিক্ত পরিচালক মোহাম্মদ মিরাজ উস সুন্নাহ সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে তদন্ত কমিটির অনিয়মের বিষয়ে সাংবাদিকদের কাছে তুলে ধরেন।

এতে অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষে দাবি করা হয়, বিতর্কিত লোক, যাদের বিরুদ্ধে কমিশন পূর্বে বিভিন্ন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে এবং এখনো Enforcement প্রক্রিয়া চলমান, তাদেরকে দিয়ে উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে পুঁজিবাজার তদন্তের নামে কমিটি গঠন করা হয়েছে।

এছাড়া বিধিতে/সরকারি নিয়মানুযায়ী কমিটির সদস্যদের প্রতি সভার সম্মানি-ভাতা বাবদ ৩০০০-৫০০০ টাকা প্রদানের উল্লেখ থাকলেও বাস্তবে প্রতিমাসে মন্ত্রনালয়ের অনুমোদন ব্যতিরেকে কমিটির বহিরাগত প্রতি সদস্যকে ২ লক্ষ টাকা প্রদান করছে মাকসুদের নেতৃত্বাধীন কমিশন। যা সম্পূর্ণরুপে পুঁজিবাজার স্বার্থ বিরোধী এবং বে-আইনী।

এর আগে গত ৫ মার্চ সিকিউরিটিজ কমিশন ভবনে এক সংবাদ সম্মেলনেও তদন্ত কমিটি নিয়ে প্রশ্ন তুলেন বিএসইসির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পক্ষে নির্বাহী পরিচালক মাহবুবুল আলম।

সংবাদ সম্মেলনে বিএসইসির মাহবুবুল আলম বলেন, বিএসইসির এই তদন্ত কমিটি বিতর্কিত। এই বিতর্কিত বলার পেছনে কারন হিসেবে রয়েছে, তদন্ত কমিটির ২ জন বাজার মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠানের। তারা বিএসইসি থেকে লাইসেন্স প্রাপ্ত হিসেবে দীর্ঘদিন ধরেই কমিশনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। একারনে এখানে একটা স্বার্থের সংঘাত (কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট) থেকে যায়।

এছাড়া তাদের তদন্ত রিপোর্ট নিয়ে প্রশ্ন তুলেন মাহবুবুল আলম। তিনি বলেন, তদন্ত রিপোর্টে অনেকটা বিএসইসির কর্মকর্তারা ‘একটিভ ভয়েসের পরিবর্তে প্যাসিভ ভয়েসে’ কেনো লিখেছে, এসব নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। যেটাকে অসদাচরন এবং দায়িত্বে চরম অবহেলা বলা হয়েছে। তদন্ত রিপোর্টে এই জাতীয় সমস্যায় তুলে ধরা হয়েছে।

তিনি বলেন, এই তদন্ত কমিটি অ্যাক্ট অ্যান্ড অর্ডিনেন্সের অধীনে গঠিত হয়েছে। এই অধীনে গঠিত হওয়া মানে সুনির্দিষ্ট কোন অনিয়ম পেলে, তা তুলে ধরবে। আমরা দীর্ঘদিন ধরে এ কাজটি করে আসছি। কমিশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরকে দোষী সাব্যস্ত করা এই তদন্ত কমিটির কাজ না। অ্যাক্ট অ্যান্ড অর্ডিনেন্সের অধীনে তদন্ত করে চাকরি বিধিমালায় শোকজ করা যায় না।

বিএসইসির কর্মকর্তাদের তদন্ত কমিটি নিয়ে দেওয়া এসব বক্তব্য প্রত্যাহারে চাঁপ দিচ্ছে ওই তদন্ত কমিটির সদস্যরা। এ নিয়ে বিএসইসির এক কর্মকর্তা অর্থ বাণিজ্যকে বলেন, তদন্ত কমিটি নিয়ে যেসব বক্তব্য সাংবাদিকদের কাছে তুলে ধরা হয়েছে, তা শতভাগ সঠিক। তারপরেও বিএসইসির চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদের প্রশ্রয়ে তদন্ত কমিটির সদস্যরা সেই বক্তব্য প্রত্যাহার করে নেওয়ার জন্য বিএসইসির বিভিন্ন কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরকে চাঁপ দিচ্ছেন।

উল্লেখ্য, সিকিউরিটিজ অ্যান্ড কমিশন অধ্যাদেশ ২১ ধারা এবং বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ডএক্সচেঞ্জ কমিশন আইন ১৭ ধারা বিএসইসি জিয়া ইউ আহমেদ এর নেতৃত্বে “অনুসন্ধান ও তদন্ত কমিটি” গঠন করে। কমিটির প্রধান করা হয়েছে ড. জিয়া ইউ আহমেদকে। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন- ইয়াওয়ার সাইদ, মো: শফিকুর রহমান, ব্যারিস্টার মো: জিশান হায়দার ও বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক মো: আনোয়ারুল ইসলাম।

জানা গেছে, ইয়াওয়ার সাঈদ এইমস বাংলাদেশ’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক থাকা অবস্থায় রিলায়েন্স ১ ও গ্রামীণ স্কীম ২ থেকে মোট ৫.৬৪ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেন। বর্তমানে এই বিনিয়োগে ক্ষতির পরিমান অর্ধেকেরও বেশি। ৯৮ টাকায় কেনা এই বন্ডের বতমান মূল্য ৪৩ টাকা। ৫ আগস্টের পর পুঁজিবাজারের অনিয়মের তদন্তে যে কমিটি গঠন করা হয়েছে তার অন্যতম এজেন্ডা সুকুক বন্ড। কিন্তু এই কমিটির অন্যতম সদস্য হিসেবে ইয়াওয়ার সাঈদের এইমস সুকুক বন্ডের বিনিয়োগকারী, এমতাবস্থায় সঠিক তদন্ত হওয়া নিয়ে বেড়েছে জটিলতা।

মিউচুয়াল ফান্ডের বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ উপেক্ষা করে ইউনিয়ন ক্যাপিটালের মত খেলাপি প্রতিষ্ঠানে আমানত রাখে এইমস বাংলাদেশ’র গ্রামীন স্কীম ২ ফান্ডটি। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত পাঁচ বছরে ইউনিয়ন ক্যাপিটালের লোকসান হয়েছে ৬২৮ কোটি টাকা। এ বিষয়ে ২০২৪ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি তারিখে ‘দৈনিক সমকাল’ পত্রিকা একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। অনেক ক্ষেত্রে আমানতকারীর অর্থ যথাসময়ে ফেরত দিতে পারছে না ইউনিয়ন ক্যাপিটাল। এই আমানতের বিপরীতে এইমস এর মিউচ্যুয়াল ফান্ডগুলো নিয়মিত মুনাফা পেয়েছে কিনা তা তদন্তের প্রয়োজন।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, এইমস এর ব্যবস্থাপনাধীন ফান্ডের ৩০ জুন, ২০২১ এর আথিক প্রতিবেদনের উপরে স্বাধীন নীরিক্ষক হিসেবে আটিসান ইউনিয়ন ক্যাপিটালে বিনিয়োগের বিষয়ে মতামত প্রদান করা সত্ত্বেও এ বিষয়ে গত ৪ বছরে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। ইয়াওয়ার সাঈদ থাকাবস্থায় এ বিনিয়োগের উদ্দেশ্য এবং অস্তিত্ব নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে, যার সঠিক তদন্তের প্রয়োজন। তৎকালীন সরকারের সময়ে প্রভাব খাটিয়ে এ জাতীয় তদন্ত কিভাবে বন্ধ ছিলো তা খতিয়ে দেখা দরকার।

ইয়াওয়ার সাঈদের ব্যবস্থাপনাধীন গ্রামীণ ওয়ান স্কিম টু ফান্ড থেকে স্বৈরাচারী সরকারের দোসর বিএসইসির তৎকালীন চেয়ারম্যান শিবলি রুবাইয়াত সিন্ডিকেটের সদস্য কারসাজির খায়রুল আলম হিরুর ফরচুন সুজের শেয়ারে বিনিয়োগ করা হয়েছে, যেখানে ক্রয়মূল্যের তুলনায় বাজারমূল্যের ভিত্তিতে বিনিয়োগের মূল্য ৬১৩ শতাংশ ও ১ হাজার ৪৬৩ শতাংশ বেড়েছে। ফান্ডটির ৩০ জুন ২০২১ ও ৩০ জুন ২০২২ সময়ের পোর্টফোলিও প্রতিবেদনে এ তথ্য দেখা গেছে। ফরচুন সুজের বিষয়টি বিএসইসির তদন্ত কমিটির তদন্তের আওতায় রয়েছে। এক্ষেত্রে সম্পদ ব্যবস্থাপক হিসেবে অতীতে এ দুটি সিকিউরিটিজে বিনিয়োগের বিষয়টি বর্তমানে তদন্ত কমিটির সদস্য হিসেবে ইয়াওয়ার সাঈদের ভূমিকা পালনের ক্ষেত্রে স্বার্থগত দ্বন্দ্ব তৈরি করবে কিনা সে প্রশ্নও উঠেছে।

এইমস-এর সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পুঁজিবাজার তদন্ত কমিটিতে অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে ড. মাহমুদ ওসমান ইমাম, ড. এবি মির্জা আজিজুল ইসলামসহ বেশ কয়েকজন বাজার বিশেষজ্ঞ ইতিমধ্যেই প্রশ্ন তুলেছেন।

পাঠকের মতামত:

শেয়ারবাজার এর সর্বশেষ খবর

শেয়ারবাজার - এর সব খবর



রে