ঢাকা, শনিবার, ১২ এপ্রিল ২০২৫, ২৯ চৈত্র ১৪৩১

মিয়া মামুনের আত্মসাতের কারখানা ফু ওয়াং ফুড

২০২৫ এপ্রিল ০৯ ০৯:২৫:০০
মিয়া মামুনের আত্মসাতের কারখানা ফু ওয়াং ফুড

অর্থ বাণিজ্য প্রতিবেদক : শেয়ারবাজারে ফু-ওয়াং ফুডস কোম্পানীর মিয়া মামুনের সিন্ডিকেটের অব্যাহত দুর্নীতি, অর্থ-আত্মসাৎ, ক্ষমতার অপব্যবহার ও জাল-জালিয়াতির কারনে বন্ধ হতে বসেছে। যে চক্রটি কোম্পানিটিকে অর্থ আত্মসাতের কারখানায় পরিণত করেছে। এ অবস্থায় কোম্পানীর সাধারণ শেয়ারহোল্ডার, শ্রমিক-কর্মচারী, ক্ষতিগ্রন্থ সরবারহকারীসহ সকল স্টেকহোল্ডারদের স্বার্থ রক্ষার্থে দুর্নীতির তদন্ত করে কোম্পানীর পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দিয়ে প্রশাসক/রিসিভার নিয়োগের জন্য আবেদন করা হয়েছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনে (বিএসইসি)। যার আলোকে বিএসইসি তদন্ত শুরু করেছে।

বিএসইসিতে দেওয়া অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০২২ সালের জানুয়ারী মাসে জাপানী বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান মিনোরি বাংলাদেশ বিএসইসির মধ্যস্থতায় একটি পারচেজ এগ্রিমেন্টের মাধ্যমে ফু-ওয়াং ফুডসের ৭.৬১ শতাংশ শেয়ার আরিফ আহমেদ চৌধুরী, তার স্ত্রী ও তার এক কন্যার কাছ থেকে ক্রয় করে। এভাবে ৭.৬১ শতাংশ শেয়ার ধারণ করে মিনোরি বাংলাদেশ লিমিটেড। এরপরে মিনোরি বাংলাদেশ এর পক্ষে ফু-ওয়াং ফুডসের পরিচালনা পর্ষদে তিনজন নমিনেডেট পরিচালক হিসেবে মিয়া মামুন, মোঃ আফজাল হোসেন ও সিদরাতুল মাহবুব হাসানকে নিয়োগ দেন। তারা পরিচালনা পর্ষদে অন্তর্ভুক্ত হয়ে কোম্পানিটির যথাক্রমে ব্যবস্থাপনা পরিচালক, চেয়ারম্যান ও নির্বাহী পরিচালক হন।

কোম্পানীর বর্তমান শেয়ারহোল্ডার মিনোরি বাংলাদেশকে ফু-ওয়াং ফুডের বকেয়া দায়দেনা পরিশোধ করে হালনাগাদ করার জন্য কোম্পানীতে কমপক্ষে ২০ কোটি টাকার নতুন তহবিল শেয়ারমানি অথবা ঋণ হিসাবে জমা দিতে বলেন (স্মারক BSEC/SRMIC/2000-922/28)। কিন্তু মিনোরি বাংলাদেশ কোন নতুন তহবিল না এনে বরং তার মনোনিত পরিচালকগন মিয়া মামুনের নেতৃত্বে কতিপয় পরিচালক ও দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের যোগসাজসে নানারকম অনিয়ম, দুর্নীতি, অর্থ-আত্মসাৎ, ক্ষমতার অপব্যবহার ও জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে কোম্পানীতে বিশৃঙ্খলা, কাচামাল সংকট, দক্ষ লোকবল ছাটাই, অযোগ্য নিয়োগ, কোম্পানীর অফিস স্পেস ও গাড়ী ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার, বাজারে নিম্নমানের পণ্য সরবারহকরে, পরিবেশকদের টাকা তছরূপ করে, সরবারহকারীদের পাওনা অপরিশোধিত রেখে কোম্পানীর দায়-দেনা বাড়িয়ে ও কোম্পানীর তহবিল থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ-আত্মসাৎ করে প্রতিষ্ঠানটিকে একটি রুগ্ন প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছে।

মিনোরি বাংলাদেশ এর মনোনীত পরিচালকরা দায়িত্বে এসে নিজ নিজ অবস্থানের সুযোগ নিয়ে, পরস্পর যোগসাজসসে বিপুল অর্থ আত্মসাৎ করেছেন।

এই ৩ জন পরস্পর যোগসাজসে ফু-ওয়াং ফুডস থেকে ২০২২ সালের জুলাই থেকে ২০২৩ ইংরেজী সালের অক্টবর মাস পর্যন্ত মোট পাচটি ব্যাংকিং লেনদেনের মাধ্যমে ১ কোটি ১০ লক্ষ টাকা আত্মসাৎ করেছেন। এই টাকা কোম্পানীর কোনরকম দায় পরিশোধ বা সরবারহকৃত মালামালের মূল্য পরিশোধ অথবা কোম্পানীর কোন খাতে অগ্রীম প্রদান এরকম কোন স্বাভাবিক প্রক্রিয়াতে লেনদেন হয়নি। বরং সম্পূর্ণ আত্মসাতের উদ্দেশ্যে তিন ব্যক্তি তাদের নিজ নিজ পদ বা অবস্থানের প্রভাব খাটিয়ে একটি পাবলিক লিস্টেড কোম্পানীর ১ কোটি ১০ লক্ষ (এক কোটি দশ লক্ষ) টাকা আত্মসাৎ করেছেন।

প্রথম লেনদেন হিসেবে বিগত ২৭.০৭.২০২২ তারিখে ফু-ওয়াং ফুডস লিমিটেড কোম্পানীর ডাচ-বাংলা ব্যাংকের বনানী ব্রাঞ্চ-এ পরিচালিত ব্যাংক হিসাব নম্বর ১০৩১১০০০৩৯০১৫ থেকে মোঃ আফজাল হোসেন-এর একমালিকানা প্রতিষ্ঠান M/S LABEEB CORPORATION এর ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের শেরপুর ব্রাঞ্চে পরিচালিত ১৫৫২১০১০০০০০৭০৪৩ নম্বর একাউন্টে রিয়‍্যাল টাইম গ্রোস সেটেলমেন্ট বা RTGS পদ্ধতিতে ইলেকট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফার করে ১৮ (আঠারো) লক্ষ টাকা সরিয়ে নিয়ে যান।

দ্বিতীয় লেনদেন হিসেবে বিগত ২৭.০৭.২০২২ তারিখে ফু-ওয়াং ফুডস লিমিটেড কোম্পানীর পূবালী ব্যাংকের গুলশান কর্পোরেট ব্রাঞ্চ-এ পরিচালিত ব্যাংক হিসাব নম্বর ০৫৯৫৯০১০১৭৯০৩ থেকে M/S LABEEB CORPORATION এর ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের শেরপুর ব্রাঞ্চে পরিচালিত ১৫৫২১০১০০০০০৭০৪৩ নম্বর একাউন্টে রিয়‍্যাল টাইম গ্রোস সেটেলমেন্ট বা RTGS পদ্ধতিতে ইলেকট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফার করে ৩২ (বত্রিশ) লক্ষ টাকা সরিয়ে নিয়ে যান।

তৃতীয় লেনদেন হিসেবে বিগত ২৮.০৭.২০২২ তারিখে ফু-ওয়াং ফুডস লিমিটেড কোম্পানীর পূবালী ব্যাংকের গুলশান কর্পোরেট ব্রাঞ্চ-এ পরিচালিত ব্যাংক হিসাব নম্বর ০৫৬৫৯০১০১৭৯০৩ থেকে M/S LABEEB CORPORATION এর ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের শেরপুর ব্রাঞ্চে পরিচালিত ১৫৫২১০১০০০০০৭০৪৩ নম্বর একাউন্টে রিয়্যাল টাইম গ্রোস সেটেলমেন্ট বা RTGS পদ্ধতিতে ইলেকট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফার করে ২০ (কুড়ি) লক্ষ টাকা সরিয়ে নিয়ে যান।

চতুর্থ লেনদেন হিসেবে বিগত ২৮.০৭.২০২২ তারিখে ফু-ওয়াং ফুডস লিমিটেড কোম্পানীর ঢাকা ব্যাংকের বনানী ব্রাঞ্চ-এ পরিচালিত ব্যাংক হিসাব নম্বর ২০৬১৭৫০০০০২৬৪ থেকে M/S LABEEB CORPORATION এর ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের শেরপুর ব্রাঞ্চে পরিচালিত ১৫৫২১০১০০০০০৭০৪৩ নম্বর একাউন্টে রিয়‍্যাল টাইম গ্রোস সেটেলমেন্ট বা RTGS পদ্ধতিতে ইলেকট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফার করে ২০ (কুড়ি) লক্ষ টাকা সরিয়ে নিয়ে যান।

পঞ্চম লেনদেন হিসেবে বিগত ০৯.১০.২০২৩ তারিখে ফু-ওয়াং ফুডস লিমিটেড কোম্পানীর ঢাকা ব্যাংক লিমিটেড এর (বর্তমানে ঢাকা ব্যাংক পিএলসি) বনানী ব্রাঞ্চ-এ পরিচালিত ব্যাংক হিসাব নম্বর ২০৬১৭৫০০০০২৬৪ থেকে প্রতিষ্ঠান LABEES CORPORATION এর আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকের উত্তরা মডেল টাউন ব্রাঞ্চে ০১৭১০২০০৭৪-৩৯৬ নম্বর একাউন্টে রিয়্যাল টাইম গ্রোস সেটেলমেন্ট বা RIGS পদ্ধতিতে ইলেকট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফার করে ২০ (কুড়ি) লক্ষ টাকা সরিয়ে নিয়ে যান।

এরপরে ২০২৩ সালের ২ এপ্রিল তখনকার ব্যবস্থাপনা পরিচালক জনাব মিয়া মামুনের নির্দেশে ঢাকা অঞ্চলের কয়েকটি সেলস টেরিটরির পরিবেশক ও সেলস-ইনচার্জকে নির্দেশ দেয়া হয় যে, ব্যবসায়িক স্বার্থে পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত পরিবেশকের টাকা (পন্য ক্রয়ের বিল, কোম্পানীর জন্য বিক্রয়ের টাকা) ব্যাংকে না দিয়ে ক্যাশে (নগদ টাকায়) দিতে হবে। যেখানে কোম্পানী হিসাবের স্বচ্ছতার জন্য ও বিভিন্ন স্থান থেকে পরিবেশকের টাকা দ্রুত সংগ্রহের জন্য ব্যাংক লেনদেনের কোন বিকল্প নেই, সেখানে সম্পূর্ণ অসৎ উদ্দেশ্যে জনাব মিয়া মামুন তার দুর্নীতির সহযোগী সিদরাতুল মাহাবুব হাসানকে দিয়ে অফিস বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করান এবং এভাবে কোম্পানীর বিক্রয়ের টাকা ক্যাশে কালেকশন শুরু করেন।

বিজ্ঞপ্তি কার্যকর করতে কোম্পানীর সেলস অর্ডার কালেকশন ও ইনভয়েস শাখার সাইফুদ্দীন এর তত্বাবধানে প্রথমে ক্যাশ টাকা কালেকশন হয় এবং তাহা তিনি ক্যাশ অফিসার মাসুদ-এর কাছে হস্তান্তর করেন। কোম্পানীর ডিলারদের নিকট থেকে অসৎ উদ্দেশ্যে এভাবে সংগৃহীত টাকা কোম্পানীর মূল ক্যাশ বইয়ে না দেখিয়ে কোম্পানীর হিসাব বিভাগে আলাদা একটি রেজিষ্টার এ লিপিবদ্ধ করানো হয়।

এভাবে কোম্পানীর বিক্রয়ের সর্বমোট ২ কোটি ১২ লাখ ৫৫ হাজার ৯৪৪ নয়শ চুয়াল্লিশ টাকা সংগ্রহ করা হয়। এরমধ্য থেকে মিয়া মামুন ২০২৩ সালের ১৫ এপ্রিল থেকে ২০ শে আগষ্ট পর্যন্ত সময়ে ১৫ দফায় সর্বমোট ১ কোটি ৯৬ লাখ ১৭ হাজার ৭৭৪ সাতশ চুয়াত্তর টাকা কোম্পানী থেকে আত্মসাৎ করেছেন। এ ব্যাপারে কোম্পানীর চিফ ফাইন্যান্সিয়াল অফিসার (সিএফও) মো: আজিজুল হক ও সিনিয়র ম্যানেজার (ফাইন্যান্স) মো: নাসির শিকদারসহ কোম্পানীর ইনভয়েস সেকশনের সাইফুদ্দিন, ক্যাশ অফিসার মাসুদসহ অনেকেই অবগত আছেন।

পরবর্তীতে কোম্পানীর সিএফও মো: আজিজুল হক ওই আত্মসাৎকৃত টাকার বিষয়ে মিয়া মামুনকে দায়ী করে ইমেইল দিলেও মিয়া মামুন এর কোন প্রত্যুত্তর দিতে পারেন নাই।

মিয়া মামুন ২০২৩ সালের ২১ শে সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৪ সালের ২০ শে এপ্রিল পর্যন্ত ফু-ওয়াং ফুডসে পরিচালানা পর্ষদের একজন সাধারন সদস্য ছিলেন মাত্র। পরিচালানা পর্ষদের একজন সাধারন সদস্য হিসাবে শুধুমাত্র পর্ষদের সভার সন্ধানী ব্যতীত, আইন অনুযায়ী তিনি অন্য কোন সুযোগ-সুবিধা গ্রহণের যোগ্য নন। অথচ আলোচ্য সময়ে তিনি ব্যক্তিগত গাড়ী ভাড়া বাবদ শুধুমাত্র ছয় মাসেই ২১,২০,৭৮২ টাকা (একুশ লক্ষ বিশ হাজার সাতশত বিরাশি টাকা মাত্র) কোম্পানীর তহবিল থেকে ব্যাংক চেকের মাধ্যমে পরিশোধ করেছেন।

এই মিয়া মামুন সম্পূর্ণ ব্যাক্তিগত প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক ভ্রমনের প্লেন ভাড়া ফু-ওয়াং ফুডস লিমিটেড কোম্পানীর তহবিল থেকে নিয়েছেন যা সম্পূর্ণ অবৈধ। তিনি ঢাকা ব্যাংকের বনানী ব্রাঞ্চ-এ পরিচালিত ফু-ওয়াং ফুডস লিঃ কোম্পানীর ব্যাংক হিসাব নম্বর ২০৬১৭৫০০০০২৬৪ থেকে হলিডে প্লানার নামক এয়ার টিকেট প্রদানকারীর অনুকুলে ইস্যুকৃত ব্যাংক চেক নং ১৬২৭১২৮ এর মাধ্যমে দুইটি আসনে ঢাকা-দুবাই-ঢাকা রাউন্ডট্রিপ ভ্রমণে ২ নভেম্বর ২০২৩ ভ্রমণ তারিখের এয়ার টিকেট বাবদ মোট ৬০৭,৫৮৪ টাকা পরিশোধ করেন। এই বিলটি কোম্পানীর তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কোন অনুমোদন নেয়া হয়নি।

একই পদ্ধতিতে মিয়া মামুন ৯টি ব্যাংক চেকের মাধ্যমে ঢাকা ব্যাংকের বনানী ব্রাঞ্চ-এ পরিচালিত ফু-ওয়াং ফুডস লিঃ কোম্পানীর ব্যাংক হিসাব নম্বর ২০৬১৭৫০০০০২৬৪ থেকে চেক নং ১৫৪৪৪৯০, ১৫৮০৯৮৪, ১৫৮১০৯৩, ১৫৮১৩১৩, ১৫৮১৯৮৮, ১৬২৭১২৮, ১৬২৭৬২৫, ১৬২৭৭৪৪, ১৬২৭৮২২ থেকে যথাক্রমে ৮৬,৬০০/-, ২৩৪,০০০/-, ১৫২,৮০০/-, ২৪৫,০০০/-, ১৭৮,৫০০/-, ৬০৭,৫৮৪/-, ১৮২,৫০০/-, ১৭৯,১১০/- ও ২৯৮,২০০/- টাকা হিসেবে সর্বমোট ২১,৬৪,২৯৪/- (একুশ লক্ষ চৌষট্টি হাজার দুইশত চুরনকাই টাকা মাত্র) টাকার বিল কোম্পানীর তহবিল থেকে ব্যাংক চেকের মাধ্যমে পরিশোধ করেছেন।

এসব বিষয়ে জানতে মিয়া মামুনের মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তিনি রিসিভ করেননি। এছাড়া ম্যাসেজ দিলেও তার কোন প্রতিত্তুর দেননি।

চলবে.....

পাঠকের মতামত:

শেয়ারবাজার এর সর্বশেষ খবর

শেয়ারবাজার - এর সব খবর



রে