ঢাকা, বুধবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৫, ১০ বৈশাখ ১৪৩২

পুঁজিবাজার থেকে পুঁজি সরবরাহ বন্ধ

২০২৫ এপ্রিল ২৩ ০৮:৪২:৩০
পুঁজিবাজার থেকে পুঁজি সরবরাহ বন্ধ

অর্থ বাণিজ্য প্রতিবেদক : পুঁজি সরবরাহের লক্ষ্যে বিশ্বব্যাপি পুঁজিবাজার গঠন করা হলেও বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে প্রাথমিক গণপ্রস্তাব (আইপিও) বন্ধ রয়েছে। বিশেষ করে বিগত ৮ মাসে কোন কোম্পানিকে আইপিও দেওয়া হয়নি। এই অবস্থায় বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) উপর ইস্যু ম্যানেজার ও উদ্যোক্তারা পুরো মনোবল হারিয়ে ফেলেছে। ফলে বিশ্বের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো রাশেদ মাকসুদের নেতৃত্বাধীন কমিশনে কোন আইপিও ফাইল জমা নেই।

রাশেদ মাকসুদের নেতৃত্বাধীন কমিশনের উপর শুরু থেকেই শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্ট কারোরই আস্থা নেই। সারা দেশের বিনিয়োগকারীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে বর্তমান কমিশন অযোগ্য। তারা শেয়ারবাজার বুঝেন না। এই বাজারে আইপিও’র গুরুত্ব অনুধাবন করার মতো অবস্থায় তারা নেই। তাদের এই অবস্থা ইস্যু ম্যানেজার এবং উদ্যোক্তাদের মধ্যেও পরিস্কার। তাই তারাও শেয়ারবাজারে আইপিওতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন।

শুধুমাত্র বাজার সংশ্লিষ্টরাই রাশেদ মাকসুদের প্রতি অনাস্থাশীল, তা নয়। স্বয়ং কমিশনের লোকজনই তাদেরকে যোগ্য মনে করেন না। বিএসইসির ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের এক সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, বর্তমান চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদের নেতৃত্বাধীন কমিশনের অনেক সমস্যার মধ্যে তাদের উপর আস্থার সংকটের কারণে গত ৮ মাসে মৌলভিত্তিক কোন কোম্পানি শেয়ার বাজারে আসার আগ্রহ দেখায়নি। এতে শেয়ার বাজার নিস্তেজ হয়ে পড়ছে। বর্তমান কমিশন কোন ইস্যু অনুমোদন না করে বাতিল করার বিষয়েই বেশি আগ্রহী।

রাশেদ মাকসুদের কমিশন যে আইপিও বাতিল করতেই পারলেই খুশি, তার প্রমাণও রয়েছে। তার নেতৃত্বাধীন কমিশন দায়িত্ব গ্রহনের সময় ১৭টি আইপিও ফাইল জমা ছিল। যেগুলোর প্রত্যেকটি তিনি বাতিল করে দিয়েছেন। যার পেছনে যৌক্তিক কারণ ছাড়া বাতিলের ঘটনাও অনেকগুলোর ক্ষেত্রে হয়েছে। এছাড়া আইনী বাধ্যবাধকতার কারনে শেয়ারবাজারে আসতে চাওয়া জীবন বীমা কোম্পানির আইপিও বাতিল করে দিয়েছেন এই কমিশন।

সম্প্রতি ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশনের এক সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনটির নেতারা বলেন, বিএসইসিতে গত ৮ মাসে কোন আইপিও পেন্ডিং নাই। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন ঘটনা নাই। এই বাজারে পণ‍্য সরবরাহ খুবই বাজে।

দেখা গেছে, গত বছরের ৫ আগস্টের পরে শেয়ারবাজারে কোন আইপিও আসেনি। এর আগে ওই বছরে বা ২০২৪ সালে ৪টি কোম্পানি আইপিওতে শেয়ার ছেড়ে শেয়ারবাজার থেকে অর্থ উত্তোলন করেছে। আগের বছর ২০২৩ সালেও ৪টি কোম্পানি আইপিওতে আসে। পরপর দুই বছরে এত কম আইপিও স্মরণকালের মধ্যে আর দেখা যায়নি। এ পরিস্থিতিকে আইপিও ছাড়া শেয়ারবাজার হিসেবে উল্লেখ করছেন বিশ্লেষক ও বাজার সংশ্লিষ্টরা।

তারা বলছেন, শেয়ারবাজারে ভালো কোম্পানির আইপিও আনতেই হবে, এর বিকল্প কোনো কিছু করা যাবে না। কিন্তু পলিসিগত সমস্যার কারণে ভালো কোম্পানিগুলো শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হতে আগ্রহী হচ্ছে না। এরমধ্যে রাশেদ মাকসুদের নেতৃত্বাধীন কমিশনের উপর অনাস্থা উদ্যোক্তাদের আইপিওতে অনাগ্রহের আরেক মাত্রা যোগ করেছে। এ কারণে শেয়ারবাজার এখন পুরোপুরি আইপিও ছাড়া হয়ে পড়েছে। দ্রুত এ সমস্যার সমাধান করতে হবে। প্রয়োজনে প্রণোদনা দিয়ে ভালো কোম্পানি তালিকাভুক্তির ব্যবস্থা করতে হবে।

আইপিওতে ধস :

তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলামের নেতৃত্বাধীন কমিশনের অধীনে ২০২০ ও ২০২১ সাল পরপর দুই বছর শেয়ারবাজার থেকে আইপিওর মাধ্যমে রেকর্ড পরিমাণ অর্থ উত্তোলন হয়। তবে ২০২২ সালে আইপিওর সংখ্যা কমে আসে। ২০২৩ সালে আইপিওতে রীতিমতো ধস নামে, যা অব্যাহত থাকে ২০২৪ সালেও। তবে রাশেদ মাকসুদের দায়িত্ব গ্রহনের পরে সেটা শুন্যতে নেমে এসেছে।

২০২৪ সালে আইপিওতে শেয়ার বিক্রি করা চার কোম্পানির মধ্যে রয়েছে- এনআরবি ব্যাংক, বেস্ট হোল্ডিং, এশিয়াটিক ল্যাবরেটরিজ এবং টেকনো ড্রাগস। এ চার কোম্পানির মধ্যে এনআরবি ব্যাংক স্থির-মূল্য পদ্ধতিতে আইপিওতে শেয়ার বিক্রি করে। বাকি তিনটি কোম্পানি বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে শেয়ারবাজারে এসেছে।

এনআরবি ব্যাংক আইপিওতে শেয়ার ছেড়ে ১০০ কোটি টাকা উত্তোলন করেছে। বাকি তিন কোম্পানির মধ্যে বেস্ট হোল্ডিং ৩৫০ কোটি টাকা, এশিয়াটিক ল্যাবরেটরিজ ৯৫ কোটি এবং টেকনো ড্রাগস ১০০ কোটি টাকা উত্তোলন করেছে। অর্থাৎ চারটি কোম্পানি আইপিওতে শেয়ার ছেড়ে মোট ৬৪৫ কোটি টাকা উত্তোলন করেছে।

এর আগে ২০২৩ সালে মিডল্যান্ড ব্যাংক, ট্রাস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স, শিকদার ইন্স্যুরেন্স এবং ক্যাপিটেক গ্রামীণ ব্যাংক গ্রোথ ফান্ড আইপিওতে আসে। অর্থাৎ ২০২৩ সালে তিনটি কোম্পানি এবং একটি মিউচুয়াল ফান্ড আইপিওতে আসে। এর মধ্যে মিডল্যান্ড ব্যাংক ৭০ কোটি টাকা, ট্রাস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স ১৬ কোটি টাকা, শিকদার ইন্স্যুরেন্স ১৬ কোটি এবং ক্যাপিটেক গ্রামীণ ব্যাংক গ্রোথ ফান্ড ১০০ কোটি টাকা উত্তোলন করে। অর্থাৎ চারটি প্রতিষ্ঠানের উত্তোলন করা অর্থের পরিমাণ ছিল ২০২ কোটি টাকা।

পরপর দুই বছর মাত্র ৪টি করে প্রতিষ্ঠান আইপিওতে এলেও ২০২২ সালে ছয়টি প্রতিষ্ঠান আইপিও’র মধ্যে শেয়ারবাজার থেকে অর্থ উত্তোলন করে। এই ছয় প্রতিষ্ঠানের অর্থ উত্তোলনের পরিমাণ ছিলো ৬২৬ কোটি ২৬ লাখ ৯ হাজার টাকা। অবশ্য ২০২২ সালের আগের তথ্য দেখলে শেষ দুই বছরের আইপিওর চিত্র খুবই হতাশাজনক। কারণ ২০২১ সালে আইপিওর মাধ্যমে অর্থ উত্তোলন করা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ছিল ১৫টি। এই প্রতিষ্ঠানগুলোর অর্থ উত্তোলনের পরিমাণ ছিলো এক হাজার ৮৫৮ কোটি ৪৪ লাখ ৪ হাজার টাকা। এর মধ্যে বেক্সিমকো গ্রিন সুকুকই উত্তোলন করে ৪২৫ কোটি ৭ লাখ ৯৫ হাজার টাকা।

২০২০ সালে ৮টি প্রতিষ্ঠান ৯৮৫ কোটি ৮৭ লাখ ২৩ হাজার টাকা, ২০১৯ সালে নয়টি প্রতিষ্ঠান ৬৫২ কোটি টাকা, ২০১৮ সালে ১৪টি প্রতিষ্ঠান ৬০১ কোটি টাকা, ২০১৭ সালে আটটি প্রতিষ্ঠান ৪১৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা, ২০১৬ সালে ১১টি প্রতিষ্ঠান ৮৪৯ কোটি ৩০ লাখ টাকা, ২০১৫ সালে ১২টি প্রতিষ্ঠান ৮৩০ কোটি ৭২ লাখ ২১ হাজার টাকা আইপিওর মাধ্যমে শেয়ারবাজার থেকে উত্তোলন করে।

২০১৪ সালে ২০টি প্রতিষ্ঠান এক হাজার ২৬৩ কোটি ৬২ লাখ টাকা, ২০১৩ সালে ১২টি প্রতিষ্ঠান ৮৩০ কোটি ৫০ লাখ টাকা, ২০১২ সালে ১৭টি প্রতিষ্ঠান এক হাজার ২০৮ কোটি ১০ লাখ ৮৭ হাজার টাকা, ২০১১ সালে ১৩টি প্রতিষ্ঠান এক হাজার ৬৭৭ কোটি ৭১ লাখ ৪৫ হাজার টাকা, ২০১০ সালে ১৮টি প্রতিষ্ঠান এক হাজার ১৮৬ কোটি আট লাখ ২০ হাজার টাকা এবং ২০০৯ সালে ১৭টি প্রতিষ্ঠান ৪৩৫ কোটি আট লাখ ৯৪ হাজার টাকা আইপিওর মাধ্যমে শেয়ারবাজার থেকে উত্তোলন করে।

অর্থাৎ গত ১৬ বছরে ২০২৩ ও ২০২৪ সালে শেয়ারবাজারে সবচেয়ে কম আইপিও এসেছে। এর মধ্যে শেষ ৮ মাসে কোনো কোম্পানির আইপিও আসেনি। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার পর ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেয়। এরপর নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি ঢেলে সাজানোর পাশাপাশি শেয়ারবাজার সংস্কারে বেশকিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। তবে নতুন কোনো প্রতিষ্ঠানের আইপিও অনুমোদন দেওয়া হয়নি।

আইপিও কম আসার কারণ :

আইপিও পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) পরিচালক মো. শাকিল রিজভী অর্থ বাণিজ্যকে বলেন, ৮ মাসে কোন প্রতিষ্ঠানের আইপিও না আসা অস্বাভাবিক। আইপিও প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা এবং ব্যাংক ঋণ সহজলভ্য হওয়া আইপিও কম আসার অন্যতম কারণ। এছাড়াও কিছু কারণ রয়েছে। বাজারের গভীরতা বাড়াতে হলে ভালো ভালো কোম্পানি তালিকাভুক্তির ব্যবস্থা করতে হবে। ভালো কোম্পানি তালিকাভুক্ত করার ক্ষেত্রে পলিসিগত যে প্রতিবন্ধকতা রয়েছে, তা দূর করতে হবে।

ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ডিবিএ) সভাপতি সাইফুল ইসলাম অর্থ বাণিজ্যকে বলেন, ‘আমাদের আইপিও ছাড়া একটি শেয়ারবাজার হয়ে গেছে। আইপিও ছাড়া শেয়ারবাজার কোনো শেয়ারবাজার নয়। আইপিও আনতেই হবে, এর বিকল্প কোনো চিন্তা করা যায় না। আমরা মনে করি আইপিওর যে প্রক্রিয়া, সেটি যারা আইপিওতে আসতে চায় তাদের জন্য কমফোর্টেবল (স্বাচ্ছন্দ্য) নয়। নিয়ন্ত্রক সংস্থার উচিত সমস্যা কোথায় সেটা বের করা এবং দ্রুত তার সমাধান করতে হবে।’

ভালো কোম্পানির আইপিও আনতে হবে ইনসেনটিভ দিয়ে :

ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) চেয়ারম্যান ও শেয়ারবাজার বিশ্লেষক আবু আহমেদ অর্থ বাণিজ্যকে বলেন, অতীতে ভালো কোম্পানি তালিকাভুক্ত করতে ওপর মহল থেকে যথেষ্ট চেষ্টা করা হয়নি। একটা বিষয়ে এখানে কোনো ইনসেনটিভ নেই। তাহলে ভালো কোম্পানি আসবে কেন? এটা নিয়ে এখন কাজ হচ্ছে। টাস্কফোর্স গঠন হয়েছে, ওরা এটা দেখবে।

পাঠকের মতামত:

শেয়ারবাজার এর সর্বশেষ খবর

শেয়ারবাজার - এর সব খবর



রে